Select Page
নিদ্রিত শোভা

নিদ্রিত শোভা

এক
২৯ জুন ১৭৮৮,
বার্মিংহাম। ইংল্যান্ড।


সকাল থেকেই বার্মিংহাম শহরে হৈচৈ পরেছে, চার্চের ঘণ্টা বাজছে বিরামহীন। প্রায় তিন বছরের অক্লান্ত চেষ্টার পর আজ ভোররাতে বার্মিংহাম শহরের মানুষের দুশ্চিন্তা এর অবসান হয়েছে। শহর জুড়ে ত্রাস চলানো এক ডাইনি ধরা সম্ভব হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে খোদ চীনদেশ থেকে তান্ত্রিক আনতে হয়েছে ডাইনি নিধন করতে।  


গত তিন বছরে শহরের অগণিত গবাদি পশু মারা পড়েছে। হাজার রকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেও লাভ হয়নি। ফার্ম হাউজগুলোর কাছাকাছিই পাওয়া যেত মৃত পশু গুলোর দেহ।  সরাসরি কোনো মানুষের ক্ষতির কথা অবশ্য শোনা যায়নি, তবে গভীর জঙ্গল থেকে মাঝরাতে ডাইনিটার চিৎকার শুনেছে অনেক মানুষ। সেই চিৎকারে নিশ্চুপ হয়ে যেত বনের ঝিঁঝিঁ পোকারাও।

মাঝে মাঝেই লোকালয়ে দেখা যেত ডাইনীটাকে। অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রী, কিন্তু কোথায় যেন ভয়ংকর একটা কিছু লুকিয়ে আছে। নির্জীব প্রাণহীন চোখে তাকিয়ে থাকত ডাইনি টি এতেই আত্মা শুকিয়ে যেত পথচারীদের। পারতপক্ষে সন্ধ্যার পর শহরের লোকজন ঘর থেকে বের-ই হতো না বলা যায়।

সেই ভীতিকর ডাইনীকে দেখতেই আজ গোটা শহর ভেঙ্গে লোক এসেছে, তাদের সবার চোখে মুখে স্বস্তির গাঢ় রেখা। ডাইনীটাকে দেখাচ্ছে বিধ্বস্ত, চুলগুলো চলে এসেছে মুখের উপরে, হাতদুটো পেছনে বাঁধা, ঠোঁটের কোনে কেটে গিয়ে কালচে রক্ত জমাট বেধে আছে।
দুপুর ঠিক বারোটা এক মিনিটে টাউন হলের সামনে পুড়িয়ে মারা হলো তাকে।


রাতে পানশালা গুলোতে বিনে পয়সায় পান চলল। পাগলাটে বুড়ো উইলবারের উদ্ভট আচরণও শহরবাসীর মনে বিরক্তি জাগালো না। ডাইনি মরেছে, এখন আনন্দ করাই যায়!
ডাইনীটার নাম কিন্তু কেউ জানতে পারেনি, আসলে জানতে কেউ চায় ও নি।

যে আমলের কথা বলা হচ্ছে, তখন গোটা ইউরোপ জুড়েই ছিল ডাইনি নিধন নামক অসুস্থ খেলার স্বর্ণ যুগ। এরকম বিভ্রান্তকর এক সময়ে বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা সুশান রাইট কে যখন জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো তখন তার সেই আর্ত চিৎকার শোনা যায় নি । শুধু  তার পুড়ে যাওয়া শরীরের চাই গুলো মিশে গিয়েছিল বার্মিংহামের পথে প্রান্তরে। সেই ছাই গুলো হয়ত কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।


২ জুন ১৮২৩,
বাণিজ্যিক জাহাজ এইচএমএস ফ্যালমাউথ।


এক দল বণিক ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষের পথে রওনা হয়েছেন।  তাদের মাঝে একজন সোয়ান হেজ, পেশায় স্বর্ণকার। ভারতবর্ষের অলংকারের সুনাম বিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। মোটা অঙ্কের লাভের আশায় অনেক ব্যবসায়ীই পাড়ি জমাচ্ছেন বাণিজ্যিক জাহাজে চড়ে, সোয়ান হেজ তাদের মতোই একজন। দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে সোয়ান চলেছেন অচেনা এক দেশে।


জাহাজের একজন কর্মী রেনা কেপি । সংসারে নিদারুণ নির্যাতিত রেনা তার স্বামী’কে খুন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল এক শহর থেকে আরেক শহরে। সুযোগ বুঝে জাহাজে চাকরিটা নিয়েছে সে, পালিয়ে যাচ্ছে কোনো দূর দেশে।

এক শুভদিনে রেনা আর সোয়ান দুজনে দুজনের কাছাকাছি আসে। রেনা খুঁজে না পাওয়া ভালোবাসা, আর সোয়ান চায় দীর্ঘ সমুদ্রভ্রমণের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি। মনে মনে কয়েকবার দ্বিধা দ্বন্দ্ব অনুভব করে নিজের স্ত্রীর জন্যে খারাপ লাগলেও পরে সেগুলো বেমালুম ভুলে যায় সোয়ান। 


রেনার  জাহাজ টির শেষ ঠিকানা ছিল ভারতবর্ষ। সেখানেই থেকে যায় রেনা।রেনার একটি মেয়ে হয়, ভারতেই থেকে যায় সে। আর ব্যবসা শেষে ফিরে যাবার সময় জাহাজেরই কিছু মানুষের হাতে খুন হয় সোয়ান হেজ। কেউ বলে ওকে স্বর্ণের লোভে খুন করা হয়েছে। আবার কেউ বলে অশরীরী আত্মা ভর করেছিল সোয়ান এর উপর। একদিন রাতে জাহাজের কাপ্তান কে  আক্রমণ করে বসে। সাত আটজন মিলেও আটকে রাখা যাচ্ছিলোনা, শেষে মাথায় গুলি করেন এক সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

২৪ জুলাই, ১৯৮১, শুক্রবার
মাইঝাটি গ্রাম।


জাবেদ সাহেবের স্ত্রীকে কবর দিয়ে আসতে আসতে ভোর হয়ে গেল৷ হাওর অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক৷ এক-একটা গ্রামে গুটি কয় ঘর, জাবেদ সাহেবদের গ্রাম এ বাড়ি আছে সর্বসাকুল্যে বিশটা৷ বছরের প্রায় সাত মাস পানিতে ঘেরা থাকে হাওড় অঞ্চলের এই গ্রাম গুলো৷ এক-একটা গ্রাম যেন বিশাল সমুদ্রে্র বুকে এক একটা দ্বীপ৷ পানি-বন্দি এই মানুষ গুলোর একমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থা হল নৌকা৷ এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে এরা সাধারণ দাঁড় বাওয়া নৌকা ব্যবহার করে আর দূরের পথের জন্যে আছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা৷ সেই ইঞ্জিন চালিত নৌকার অবস্থাও যে খুব বেশি উন্নত তা না৷ শীত কালে যখন ৪-৫ মাসের জন্যে পানি নেমে যায় এই এলাকার মানুষেরা তখন চাষবাস করে৷ পানি নেমে যাওয়ায় এক বিশাল ফাঁকা অঞ্চল সৃষ্টি হয়, এক প্রান্তে দাঁড়ালে যার আরেক প্রান্ত দেখা যায় না৷ এলাকায় তখন যেন প্রাণের সঞ্চার হয়- বর্ষা কালের মাঝিরা হয়ে যায় কৃষক, নৌকার ইঞ্জিন গুলো হয়ে যায় ক্ষেতের পানি সেচের পাম্প৷


শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজনের অনুরোধে স্ত্রীর কবরটা নিজের শ্বশুরালয়েই দেয়াড় জন্য মনস্থির করলেন জাবেদ সাহেব। যেহেতু গ্রাম দেশ, সারা রাত লাশ নিয়ে বসে থাকার মানে নেই৷ মুরুব্বিদের তাগাদাও চলতে থাকে মৃতকে দ্রুত কবর দেয়াড় জন্য৷ যত দ্রুত কবর দেয়া হবে ততই মঙ্গল৷এই গরমের  রাতে সারা রাত লাশ টেকানো যাবে না, এই শঙ্কা টি রয়েই যায় । অগত্যা রাতেই কবর দিতে রওনা হতে হলো । 


সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে মাইঝাটি ফিরতে ফিরতে এখন রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো বলে।
ওদিকে মা মরা মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে শেষ । সকাল থেকে একটানা আহাজারি করতে করতে এখন গলা স্তিমিত হয়ে আসছে, তবু এক অস্পষ্ট গোঙানি শোনা যায় । মা  মরা মেয়ের সেই কান্নার শব্দ কাঁপন ধরায় বুকে, হাহাকার সৃষ্টি কর ।


জাবেদ সাহেব অনেক চেষ্টা করেও মেয়ের কান্না থামাতে পারলেন না৷ তাঁর বোন রাশেদা বললো, 


‘ভাইজান ওরে আমি দেখছি, আপনে যান, একটু বিছানায় শরীরটা লাগান। কাইন্দা কি ফায়দা অখন কন?’   


জাবেদ সাহেব গেলেন৷ কিন্তু ঘুম হল না৷ সেদিন দুপুর পর্যন্ত কান্না চললো  জাবেদ সাহেবের মেয়ের। 

দুই
আজ ছয় বছর পর বাড়ি ফিরছে অকিল৷ ছয় বছরকে খুব একটা বড় সময় মনে না হলেও বিদেশের মাটিতে ছয় বছর কি তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়৷ অকিল দেখতে মোটাসোটা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা৷ চশমার ডাটিটা একটু ঢিলে, বার বার নাক দিয়ে পিছলে পড়তে থাকে। অকিল একটু পর পর তা হাতের তালু দিয়ে ঠিক করে৷ দুই মাস ধড়ে চশমাটা পাল্টাবে ভাবলেও পালটানো হচ্ছে না৷ গত তিন ঘণ্টা ধড়ে নৌকাতে বসে আছে ও৷ নৌকাটা চালু হওয়ার পর ইঞ্জিন এর ভট ভট শব্দ কানে ধরছিল খুব৷ অসহ্য রকম শব্দ৷ এতক্ষণ ধড়ে বসে থেকে এখন সেটা অনেকটাই স্বাভাবিক লাগছে, তবে মাথা টনটন করছে। নির্ঘাত মাথা ব্যথা শুরু হবে৷ বাড়ি পৌঁছাতে আরো ঘণ্টা দুই বাকি৷ মাথা ব্যথা আজ নিশ্চিত৷ বাড়ি আসবার আনন্দ সব উবে যাচ্ছে এই ভটভট শব্দ আর মাথার দপদপানিতে। এই জীবনে অকিল খুব কম জিনিসই ভয় পায়৷ মাথা ব্যথা তার মাঝে একটা৷ একবার শুরু হলেই হলো, ব্যথার চোটে তখন না যাবে শোয়া না যাবে বসা।মাথা ব্যথা থেকে মন ঘুরানোর জন্য পাশে বসা পাশে বসা গ্রাম সম্পর্কের চাচা কলিমুদ্দীনকে বললো অকিল,


‘চাচা, গ্রাম টা তো বোধহয় একদম বদলে গেছে না? চিনব নাকি নৌকো থেকে ?’ 

কলিম চাচা একটু হেসে বললেন,

‘বাজান, মনে হয় না চিনবা, অনেক টুকু ভাঙ্গা পরেছে নদীতে, ঘর বাড়ি বদলিয়েছে, বুঝোই তো, মেলা দিন পার হইলো তুমি যাওয়ার পরে। কদ্দিন বাদে জানি ফিরলা?’


‘এইতো চাচা, ছয় বছর হবে।’


‘তাইলে বোঝো!’ 

উনার সাথে একমত হয়ে মাথা নাড়ল অকিল৷ এখন শীত কাল৷ পানি অনেকখানি নেমে গেছে৷ চাচা জানালেন আর কিছুক্ষণ পর নৌকা যাবে না৷ প্যাঁক-কাদা মাড়িয়ে হাঁটতে হবে৷ গ্রামের এই জিনিসটা এখনো বদলায়নি! 

‘বাবা হাঁটতে পারবা তো?’ শুধালেন কলিমুদ্দিন।

‘জি চাচা। কি বলেন এইটা? পারব না আবার!’ 

‘তাইলে জিনিস পত্র কাইচ্চা লও, আর বেশি দেরি নাই।’

দুই মাঝি অনেক কসরত করে নৌকা ঘাটে লাগালো৷ ঘাটটা যে অস্থায়ী সেটা বোঝাই যায়৷ নামতেই কাঁদার মাঝে পা ডুবে গেল অকিলের। দুইশো’ ডলারের নাইকি জুতা, বুকটা খচ করে উঠলো অকিলের৷ একটু সামনে এগিয়ে জুতা খুলে প্যান্টের বেল্ট বাঁধার জায়গায় বেঁধে নিলো সে, এতে হাঁটার গতিও বেশ বাড়ল৷ হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করল ওর বয়সী একটা ছেলে ওর পাশাপাশি হাঁটছে৷ ভাল করে তাকাতে কেমন চেনা চেনা লাগলো।

‘কিরে তুই সাগর না?’

‘শালা, চিন্তে পেরেছিস তাহলে!’

‘কি বলিস, পারবো না আবার!’

বলে একজন আরেকজন কে জড়িয়ে ধরল৷ খুব বেশি বন্ধু অকিলের কোনো কালেই ছিল না। সবার মধ্যে সাগর ছেলেটাই ছিল অন্যরকম। খুব বিশ্বস্ত ছেলে, তাই ঘনিষ্ঠতাও বেশি ছিল। আজ ছয় বছর পর সামনাসামনি দেখা, বুকটা ভরে গেল অকিলের।  

তিন

গ্রামের বাড়িতে রাত নয়টা মানে নিশুতি। কিন্তু আজ তেমন মনে হচ্ছে না। ঘর ভর্তি মানুষ। সবার উৎসাহ অকিল কে নিয়ে। এই ঘর ঐ ঘর করে এক এক বাড়ি থেকে এক এক জন আসছে। কেউ আসছে পিঠা, কেউ টাটকা মাছ বা সবজি আবার কেউ আসছে ঘরে পাতানো খাঁটি ঘি নিয়ে। এতো আতিথেয়তা দেখে মনটা ডুকরে কেঁদে উঠল অকিলের। এমন একটা দেশে ছয়টা বছর কাটাতে হয়েছে, যেখানে বিনে পয়সায় একটা দানাও কেউ কখনো দেয় নি। 

দেশের বাইরে যাওয়ার পর এক বাঙালি আত্মীয়ের বাসায় প্রথম উঠে সে। বাড়ির কর্তা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, নেহাত অকিলের বাপের কাছে ঋণী তাই জায়গা দিয়েছেন। দুই দিনের মাঝে নিজের ব্যবস্থা করে সরে পড়তে হবে। দু’দিন পরেও যখন কোনো থাকার জায়গার ব্যবস্থা হয় নি, তখন আরো পাঁচদিন থাকার জন্য গুনে গুনে এক সপ্তাহের ভাড়া হিসেবে সত্তর ডলার দিয়ে আসতে হয়েছে তাকে। বাড়ির স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার হওয়া একটা ঘরে শুরু হয়েছিল অকিলের প্রবাস জীবন। 

‘কিরে কি ভাবছিস?’ পিঠে সাগরের চাপড় খেয়ে সম্বিত ফিরলো অকিলের।

‘কিছু না রে বন্ধু, ভাবছিলাম এতো মায়া ছেড়ে কেন বাইরে গিয়েছিলাম!’ 

‘শালা ভীমরতি ধরেছে নাকি, হ্যাঁ? এতো ভালো দেশ এতো উন্নত দেশ আর তুই মায়ার কথা বলিস! কি আছে তোর নিজের দেশে? আমার কথাই ধর। এই যে পুলিশ এর চাকরি করি, কয় টাকা বেতন পাই? বেতনের টাকায় মাসের কয়দিন যায় শুনবি?’ 

‘আচ্ছা ভায়া, বাদ দে। ভাল কথা তোর বোন কোথায়?’

‘আজ আসতে পারেনি রে, একটু ঝামেলা আছে। কাল আসবে। জাবেদ দের বাড়িতে ও একটু সাহায্য করছে, ওদের বড় বিপদ৷’ 

‘সে কি? কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?’

‘জাবেদ কে তো চিনিস, আরজ চাচার ছেলে।’

‘হু, চিনি। ভালো ফুটবল খেলতো। শুনলাম জাবেদের বউটা মারা গেছে। এতো অল্প বয়স মেয়েটার, খারাপ লাগলো খুব।’ 

‘জাবেদের একটা মেয়ে হয়েছে জানিস বোধহয়, রীতি নাম।’

‘হ্যাঁ, ওকে তো তিন-চার বছরের দেখে গিয়েছিলাম।’ 

‘হ্যাঁ, আর বলিস না। মা মারা যাবার পরপর এই মেয়ে কে জ্বীন ধরেছে!’  

‘আরে ধুর, ফাজলামি করার জায়গা পাস না! জ্বীন ধরেছে? শালা ভেবেছিস গ্রামে এসেছি অনেক দিন পর ,ভয় পেয়ে যাব! না?’ 

কথা টা বলতে বলতে একটা অট্টহাসি দিল অকিল। পরক্ষণেই লক্ষ্য করল সাগরের মুখটা কালো হয়ে গেছে। বোঝাই যায়, ব্যাপারটা নিয়ে সে বেশ সিরিয়াস। নিশ্চয়ই কোথাও ঘাপলা আছে। জিন-ভূত এ অকিলের কোনো বিশ্বাস নেই। ও ভীষণ বাস্তববাদী মানুষ।  

‘বন্ধু তুই তো আমাকে চিনিস তাই না? আর তুই এটাও জানিস আমি ভীষণ বাস্তববাদী মানুষ। এসব জ্বীন-ভূতে  আমি বিশ্বাস করি না।  তবে তোরা যেটাকে জিন-ভূত বলে চালিয়ে দিস সেটাকে আমি বলি unexplained phenomenon. এখন তুই বলতে পারিস যাহা unexplained phenomenon তাহাই ভূত। দুটোর শুধু দুই নাম। কিন্তু ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তা না। ধর তুই আকাশে উজ্জ্বল একটা বস্তু ভাসতে দেখলি। ওটা প্লেন না তুই নিশ্চিত, এখন তুই বললি ওয়াও এটা নিশ্চয়ই ফ্লায়িং সসার।  আমার কথা হল ভাই তুই জানিস না ওটা কি। এখন ওটা প্লেন না হলেই ফ্লায়িং সসার হবে কেন? একইভাবে তুই বলতে পারিস না রীতিকে জ্বীনে ধরেছে। ওর আচরণ অস্বাভাবিক মনে হলে বলতে হবে অস্বাভাবিক আচরণ। জিন-ভূত বলে সব কিছুকে লেবেল দেয়া খুবই যুক্তিহীন একটা কাজ।’

‘ভাই তোরা অনেক পড়া লেখা করেছিস অনেক জ্ঞান গরিমা। আমরা তোদের সাথে কথা বলে পারবো কেন।’

কথা টা বলে মনে মনে ভীষণ রাগ করল  সাগর৷

‘আরে ভাই তুই দেখি ব্যাপারটা পার্সোনালি নিলি। শোন তাহলে বলি কি, আমি কাল দেখতে যাব রীতি কে। আচ্ছা বল তো সমস্যাটা কি? কেন তোদের মনে হলো মেয়েটাকে জ্বীনে ধরেছে?’

‘সে তো অনেক বড় গল্প…’

‘আরে শুরু কর, এতদিন পর এলাম আজ! আড্ডা দিয়েই পার করে দিবো সারারাত!’ 

‘সে কি, এতো ধ্বকল সহ্য করে এতো দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এলি। বিশ্রাম নে তো, কাল সকালে অনেক কাজ আছে, বিকালে তোকে নিয়ে যাবো ওখানে। যাবার পথে গল্পটা শোনাব তোকে।’ 

সাগর চলে গেল, অনেক অনুরোধের পরও রাতে খেয়ে গেল না। সম্ভবত রাগ করেছে, মনে মনে ভাবল অকিল। হয়ত এতো কড়া ভাবে বলা ঠিক হয় নি। গ্রাম গঞ্জের মানুষ অনেক সাদাসিধা, সহজ তাদের জীবন বোধ। unexplained phenomenon জাতীয় তত্ত্বকথা চাইতে  ভূতে বিশ্বাস করে ফেলাটাই এদের কাছে সহজ, এটা বোঝা উচিত ছিল অকিলের। কিন্তু কি করবে উলটা পালটা কিছু দেখলে সেটা ধরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত অস্বস্তি  লাগে তার। নিজের কাছেই খারাপ লাগতে থাকল। ওদিকে অকিলের মা মালতী দেবী দু’বার খেতে ডেকে গেছে, এ নিয়ে তৃতীয় বার এলেন- 

‘ও বাবা, দুই চাইর দানা মুখে কিছু দে, ও মা সাগরটা গেলো কই? বলি, ছোট ঘরে গেল নাকি?’

‘না মা, সাগর বাড়ি চলে গেছে।’  

‘হায় ভগবান, চলে গেলো মানে টা কি? তুই আসলে কি কি করবে কি কি খাওয়াবে গত দুই তিন মাসে তো সেই গল্প করেই আর রাখে না, এখন চলে গেল? বুঝি না বাপু।’ 

রাগে মালতী দেবী গজ গজ করতে চলে গেলেন। উনি যত টুকু রাগলেন তার থেকে বেশি কষ্ট পেলেন। মালতী দেবীর মনে হচ্ছে অকিল বদলে গেছে। উনার সন্দেহ হচ্ছে উনাকে না জানিয়ে বিয়ে টিয়েও হয়ত করে ফেলেছে। নির্ঘাত ইনিয়ে বিনিয়ে কোনো একদিন বলে বসবে মা বিয়ে করে ফেলেছি। কোনো সাদা চামড়ার মেয়েকেই হয়ত ঘরে তুলতে হবে। এমনই পোড়া কপাল, ছেলেটাও তাহলে বিদেশেই থিতু হবে। ভাবতে ভাবতে অকিলের মা কেঁদেই দিলেন।  

ওদিকে অকিলের এতো মানুষের হৈচৈ  ভাল লাগল না। কেন যেন মনে হলো সাগর যায় নি। এতো দিন ধরে বসে আছে ওর জন্যে আজ হুট করে চলে যাবে? যেতেও পারে, মানুষের আশা যত বেশি, উত্তেজনা যত বেশি, সে কষ্টও পায় তত বেশি।

বাড়ির বাইরে যেতেই সাগরকে পাওয়া গেল৷ বাড়ির সামনে একটা গাছে হেলান দিয়ে বিড়ি টানছে৷ অকিল পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই পকেট থেকে আরেকটা বিড়ি বের করে দিল অকিলকে৷

‘বিড়ি খাওয়াটা এখনো ছাড়তে পারলি না রে ? সিগারেট খেলেই পারিস৷’

‘সিগারেট বিড়ি, টমেটো টমেটো, একই জিনিস ভায়া।’

‘হু, তা বটে।’ 

‘ঘাটে যাবি নাকি? আগের মত নেই অবশ্য।’ 

‘যাই চল।’

‘এতো শীত আগে পাইনি রে?’

’এই এটা তোর মানিব্যাগ নাকি রে?’ বলে একটা মানিব্যাগ সাগরের পায়ের কাছ থেকে তুলে দিল অকিল৷ 

‘হু, বিড়ি বের করতে গিয়ে পড়ে গেছে মনে হয়৷ তুই শীতের দেশ থেকে এসেও শীতের কথা বলছিস?’ 

‘হু, এখানের শীত আর ঐ শীত এ অনেক তফাত । আচ্ছা গ্রাম টা পুরো বদলে গেছে না রে?’

‘হু, তবে, সাদেক চাচার দোকানটা কিন্তু এখনো আছে ঘাটের পাশে।’

‘তাই নাকি, মরে নি ঐ বুড়ো?’

‘নাহ! তোর কাছে কুড়ি টাকা পায়, ওটা না নিয়ে কবরে যাচ্ছে না’ 

‘আজ সব পাওনা মিটিয়ে দেব, কি বলিস?’

‘হাহা, ব্যাটা সুদ চায় কিনা দেখ, দেখা যাবে বিশ টাকা দুই হাজার টাকা হয়ে গেছে৷ ছয় বছরে সুদ কম হবে না৷’ 

সাদেক চাচাকে অবশ্য পাওয়া গেল না, যাকে ঐ দোকানে পাওয়া গেল সে হচ্ছে সাদেক চাচার ছেলে, আবুল।  আবুলের বয়স নয়-দশ হবে৷ ওকে ছোট দেখে গিয়েছিল অকিল৷ আবুলের দিকে তাকিয়ে চায়ের ফরমাশ করলো সাগর। 

‘আচ্ছা বন্ধু বল দেখি রীতি মেয়েটার কেইসটা কি?’

সজোরে বিড়িতে একটা টান দিয়ে অকিলের হাতে বিড়িটা গুঁজে দিয়ে শুরু করল সাগর। 

‘গতবারের বর্ষাকালের কথা, সেটা ছিল বৃহস্পতিবার। কোনো কারণে জাবেদ ভাই তার বউয়ের সাথে ঝগড়া করলেন। সময়টা ধর আনুমানিক মাগরিবের আজানের আধ ঘণ্টা আগে। জাবেদ ভাই বাড়ি এসে দেখলেন রীতির মা শুয়ে আছে, তার মেয়ে ডাকছে মা উঠো উঠো। উনি ভাবলেন বউ হয়ত রাগ দেখাচ্ছে। উনি রাগ ভাঙাতে গিয়ে দেখলেন তার বউয়ের শরীর একদম নিথর। কোনো রেসপন্স নাই। মারা গেছে।’ 

‘বলিস কি, মাই গড!’

‘এটা তো কিছু না, সমস্যা শুরু হয়েছে এর পর।’

‘মানে?’

‘জাবেদ ভাইয়ের বউকে রাতেই কবর দেয়া হল, ভাবির বাপের বাড়িতে। জাবেদ ভাইয়ের ফিরতে ফিরতে সকাল, মানে ভোর হয়ে গেল আরকি। কিন্তু উনার মেয়ে তো ছোট। সে তার মায়ের জন্যে হুলুস্থুল কান্নাকাটি শুরু করল। বাচ্চা মেয়ে কি আর বোঝে। কান্না আর থামে না। দুপুরের দিকে জাবেদ সাহেব খুব রাগ করলেন। মেয়েকে একটা চড় মারলেন। মেয়ের কান্না থামলোও সেই চড় খেয়ে। এরপর মেয়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ঘুম আর ভাঙে না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত,  তারপরের দিন ভোর হয়ে এলো- মেয়ের ঘুম ভাঙে না। দুপুরে মেয়েকে নিয়ে তারা রওনা হলো সদর হাসপাতালে৷ নিতে নিতে রাত। মেয়ের ঘুম ভাঙছে না। ডাক্তার বলে কোমায় চলে গেছে। আরেকজন young ডাক্তার সে বলে না এটা কোমা না। সিনিয়র ডাক্তার আর তরুণ ডাক্তার এর মাঝে মনোমালিন্য। গভীর রাতে দেখা গেলো মেয়ে বিছানার চাদর খেয়ে ফেলেছে। গায়ে ভীষণ শক্তি। ৪ জন মিলে আটকে রাখা যায় না। পাশের রোগীর আস্ত কলার কাঁদি খোসা সহ খেয়ে নিল, তেলের কৌটা বোতল সহ কামড়ে খেয়ে ফেলল। কেমন ফ্যাকাশে চেহারা চোখ এ কোন প্রাণ নাই৷ নির্জীব ভাবে তাকিয়ে থাকে, দেখলে মনে হবে কোনো মৃত মানুষ হাঁটছে-খাচ্ছে। খেয়ে হঠাৎ ই শরীর টা নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। টানা আরো ৬ দিন এমন চলল। কোনো রাতে উঠে খেত কখন ও উঠে না। ৬ দিন পর সেই ঘুম ভাঙল । মেয়ে এসব কিছু ঘুম ভেঙে বলতে পারে না। শুধু বলে। মা এর কাছে নিয়ে চল। মা ঢাকায়। মা এর কাছে যাব। মা ভুতের গালে ভুতের গালে। গাল জিনিস টা কি আমরা কেউ বুঝলাম না। সেটা কি মুখের গাল? কি বুঝতে চায়, ভূত খেয়ে ফেলেছে মা কে? না কি আমরা কুল কিনারা পেলাম না।

ডাক্তার রা চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। বললেন বাড়ি নিয়ে সৃষ্টিকর্তা কে স্মরণ করতে, তারা অপারগ। এখানেই শেষ না ৪ মাস গেল ভালোই। শুধু মা এর কাছে যাবে এটা বলে। আর উদ্ভট কথা বলে। কোনো মানে হয় না সেগুলোর। চার মাস পর আবার একই ঘটনা। কিন্তু এবার আরো মারাত্মক। গত দু মাস ধড়ে সেই মেয়ে ঘুমাচ্ছে। কখনো ছয় সাত দিন, আবার কখনো এক দুই দিন পর পর গভীর রাতে জেগে উঠে, সামনে যা পায় খেয়ে ফেলতে চায়। হেনো কিছু নাই যে খায় না। একদিন রাতে বেড়িয়ে মুরগি এর খোপ থেকে জীবন্ত মুরগী কাঁচা খেয়ে ফেলেছে তিন চার টা। ভয়ংকর বেপার।’

এক নিশ্বাস এ কথা গুলি বলে গেল সাগর। মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনল  অকিল। নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে। নিজের কান কে বিশ্বাস হচ্ছে না। এও কি সম্ভব? ২ মাস ধড়ে একটা মানুষ ঘুমায়?

চার
পরের দিন আর যাওয়া হল না অকিল এর৷ কোনো একটা কারণে সাগর কাজে আটকে গেছে৷ সে আসতে পারল না৷ অকিলের মন টা বিক্ষিপ্ত ভাবে এই চিন্তা ঐ চিন্তা করছে৷ কিন্তু কোনো কিছুতেই মন বসছে না৷  সাগর এর বলা  ঘটনা টা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না৷ নিশ্চয়ই এর কোনো ব্যাখ্যা আছে৷ ভূত নিশ্চয়ই না,  ভূত বলতে আমরা যা বুঝি তা থাকতেই পারে না৷ এদিকে বাড়িতে কোনো কাজ নাই৷ কি করবে, সময় কাটে না৷ মাঝে কিছু বাই পত্র নিয়ে পড়া শোনা করল৷ কিন্তু ঐ যে ওর মাথায় একটা জিনিস ঢুকেছে৷ এখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না৷ 

সেদিন রাতের কথা৷ গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল অকিলের৷ ঘরের আশেপাশে কোনো শব্দ হচ্ছে মনে হল৷ নিশ্চয়ই কোনো জীব জন্তু হবে৷ চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল অকিল৷ কিন্তু মনে হল শব্দ টা হচ্ছে৷ একটা নির্দিষ্ট  তালে ৷

একটা আর্ত-চিৎকার, তার পর কিছুক্ষণের বিরতি৷ মনে মনে সেকেন্ড হিসাব করল অকিল৷ ২ সেকেন্ড৷ আবার চিৎকার টা শোনা গেল৷ হাওর অঞ্চল, এখানে অনেক দূরের শব্দ বাতাস আর পানিতে করে ভেসে আসে  মনে মনে ভাবল অকিল, কোথায় না কোথায় হচ্ছে ধুর ঘুমাই৷ আবার হল,  আবার ২ সেকেন্ড পর আবার, এবার সুর একটু পাল্টেছে৷ এভাবে চলতেই থাকল৷ অকিল চোখ বন্ধ করে থাকল, বোঝার চেষ্টা করল এটা কি ওর মনের ভুল নাকি আসলেই হচ্ছে শব্দটা৷ এক সময় মনে হল ও কি ওর নিজের মনের ভুল না তো ? তো নিজের ভ্রম কাটানোর চেষ্টা করল৷ ঘুমের ঘোর আছে কিনা বুঝতে চাইল,  না সেটা তো হতে পারে না৷ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে  শব্দটা ঘরের বাইরে থেকে৷ 

এক সময় যখন আর পারল না উঠে পড়ল বিছানা থেকে৷ অন্ধকার ঘরে এদিক ওকিদ হাতড়ে হারিকেন টা পাওয়া গেল৷ হারিকেন টা জ্বালিয়ে মনে হল শব্দটা আরেকটু দ্রুত হচ্ছে৷ ২ সেকেন্ড এর বিরতিটা মনে হয় এখন আধা সেকেন্ড হয়েছে, এক সেকেন্ড ও হতে পারে৷ বোঝা যাচ্ছে না৷ একটা ডিজিটাল ঘড়ি ওর আছে সেটা এই অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না৷ 

ঘরের দরজা টা খুলতেই একটা ঠান্ডা বাতাস ওকে ধাক্কা দিল৷ শরীরের হাড় সহ কেঁপে উঠল৷ এটাকেই মনে হয় বলে হাড় কাঁপানো শীত৷ অকিলের ঘর টা জমি থেকে কিছুটা উঁচুতে৷ নতুন বাড়ি, নামতে গিয়ে খেয়াল করেনি৷ ধুপ করে পড়ে গেল৷ হারিকেন টা হাত থেকে পড়ে গেল৷ অকিলের মাথা টা ঠুকে গেল বাড়ির সামনে রাখা একটা  লোহার বালতি তে৷ ব্যথায় মাথা টা টন টন করে উঠল অকিল এর৷ নিশ্চয় কেউ বাথরুম এ যাওয়ার জন্য পানি আর বালতি রেখেছিল ঘরের সামনে৷ আছাড় খেয়ে হারিকেন টা নিভে গেছে৷ বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ কষ্টে শিষ্টে উঠে বসল অকিল৷ অনেক মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা হয়ে যেতে পারত অকিল এর৷ মাথা ঠুকে কত মানুষ মারা যায় প্রতি বছর৷ কত মানুষ যায় ? এর নিশ্চয় কোনো  স্ট্যাটিস্টিক আছে৷ দেখতে হবে খোঁজ নিয়ে৷ মাথা টা ভীষণ ব্যথা করছে৷ হাত দিয়ে কপালে বুঝতে পারল রক্ত পড়ছে৷ শরীরের চাদর টা দিয়ে কপালে চেপে ধরল৷ ফাটেনি নিশ্চয়ই , ফাটলে জ্ঞান থাকার কথা না৷  চামড়া ফেটে কেটে গেছে হয়ত৷ বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা বুঝল মা কে ডাকতেই হবে৷ শরীর টা বিশেষ ভাল লাগছে না৷ কেমন যেন বমি আসছে৷ কিন্তু উঠতে গিয়ে পারল না৷ মাথা ঘুরাচ্ছে৷ অনেক রক্ত বের হয়েছে হয়ত ভাবল অকিল৷ শেষে চিৎকার করে ডাকল মা মা ও মাআ৷ তিন বার ডেকে কি যেন একটা মনে পড়ল অকিলের , কিন্তু কি যে মনে পড়ল কি যেন মাথায় আসি আসি করেও আসল না৷ কি যেন একটা ও ধরতে পেড়েছে, বুঝতে পেড়েছে  কিন্তু সেটা কি? নাহ, কিছুতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছে না৷ তবে অকিল যে জিনিস টা খেয়াল করল না তা হল চিৎকার টা থেমে গেছে … শব্দটা থেমে গেছে এখন আর হচ্ছে না৷ 

পরের দুদিন জ্বরে কষ্ট করল অকিল৷ তৃতীয় দিন কিছু টা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারল ও৷ সেদিন সাকালেই ঠিক করল আজই যাবে ও দেখে আসবে রীতির সাথে৷ এই দুই দিন জ্বরের ঘোরে তেমন কিছু করতে পারে নি ও৷ মাঝে মধ্যে নাপা খেয়ে যখন জ্বর কমেছে তখন রীতির কথা ভেবেছে অকিল৷ ব্যাপার টা ও কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছে না৷ 

সকাল দশটার দিকে সাগর এল৷ 

‘জ্বরে তো মরতে বসেছিলাম ভায়া, তুই তো এসে দেখা ও করলি না৷ কিছু হয়েছে নাকি?’

‘হ্যা রে, শালার এক মন্ত্রী এসেছে, তার ডিমান্ড এর শেষ নাই৷ চাকরি নিয়েছি পাবলিক এর আর সেবা করি কাদের! তা তোর খবর শুনলাম কাল রাতে তাই আজ চলে এলাম৷ হয়েছে কি’

‘ভায়া বাথরুমে যেতে যেয়ে পড়ে কি বিচ্ছিরি অবস্থা বল৷ বালতি টা কপালে ঠুকে গেল!’

‘কদিন শহুরে জীবন যাপন করে তুই কি যে হয়েছিস৷ রেস্ট নে নড়া চরা করবি না৷ সুস্থ হ’

‘না রে আজ তোর রীতির কাছে নিয়ে যেতে হবে৷’

‘বলিস কি রে? তোর পাগলামি গেল না৷ আগের মতই আছিস৷ ডিটেকটিভ হওয়ার শখ টা যখন এত আমার মত পুলিশে যোগ দিতি৷ এখনো সময় আছে কুয়ালিফিকেশন তো ভাল যোগ দিয়ে দে৷’

‘আরে ধুর ও সব চাকরামি করতে পারব না৷ নে ধর উঠা, স্নান টা করেই রওনা দিব৷ তুই জল খাবার টা খেয়ে নে, মা কে বলে রেখেছি তোর প্রিয় দুধ চিতল বানিয়েছে যা৷’

পাঁচ

বিশাল একটা নৌকাতে মাত্র পাঁচ জন মানুষ৷ ২ জন মাঝি, অকিল, সাগর আর তার বোন সাহেদা৷  কুয়াশাতে ২ হাত সামনে ও কিছু দেখা যায় না৷ অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে অকিল এর৷ ও শুধু সাগর আর ওর বোন কে দেখতে পাচ্ছে৷ নৌকার দুই মাথার দুই মাঝি কে ও দেখা যাচ্ছে না৷ অদ্ভুত ব্যাপার, মাঝি রা ঠিক পথে যাচ্ছে তো ? মনে মনে যখন এই কথা ভাবছিল সাহেদা বলে উঠল 

‘ভাই চা দিব?’

অকিল বেশ আনমনে ছিল শুনতে পায় নি৷ সাহেদা তার ভাই কে একটা গুঁতা দিল৷ এবার সেই গুঁতা এসে পড়ল অকিলের কাঁধে৷ 

‘কি, চা হবে?’

‘হুহু, দে দে’ জবাব দিল অকিল 

সাহেদা সবাইকে চা দিল৷ দুজন মাঝি তারাও পেল৷ চা খাওয়ার বিরতি চলছে তাই নৌকা খুব ধীরে চলছে৷ ডানে বায়ে একটু দুলছে৷ মাঝে মাঝে ঢেউ এর বাড়িতে অল্প বিস্তর ছলাত ছলাত শব্দ হচ্ছে৷ এ ছাড়া পুরোটা পরিবেশ নিস্তব্ধ নীরব৷ মাঝে মাঝে নীরবতায় কানে তালা লেগে যায়৷ এখনকার দুনিয়াতে যে পরিমাণ হৈ চৈ কোলাহল তাতে এই অনুভূতি একই সাথে স্বর্গীয় আবার অস্বস্তিকর অচেনা একটা অনুভূতি মনে হল৷ কানের পেশে যেন একটা ঝি ঝি শব্দ কান দুটোকে চাপ দিয়ে রেখেছে৷ যত সময় যায় তত ভাল লাগে কিন্তু অস্বস্তি তত বাড়ে৷ নীরবতা ভাঙ্গল সাহেদার মিষ্টি কণ্ঠ৷ 

‘ভাই আপনার কথা অনেক শুনেছি, মাঝে মধ্যে মনে হত আপনি আমাদের পরিবারেই থাকেন৷’

‘তাই নাকি? কিরে সব সিক্রেট ফাঁশ করে দিয়েছিস ?’

‘আর ধুর কি বলিস, নাহ তেমন কিছু না৷ আমার তোর গল্প করি এই আরকি স্মৃতি তো আর কম না৷’

‘তা আপু, রীতির গল্পটা শুনেছেন নাকি?’

‘জী ভাই, আপনার বন্ধু ভাবে জীন ভূতের কারসাজী’

‘আপনি ভাবেন না? আপনার কি মনে হয় ?’

‘ভাই জীন ভুত কিনা জানি না, তবে এইটুকু বলতে পারি এভাবে এই অজপাড়া গাঁ এ ফেলে রেখে এই সমস্যার সমাধান হবে না৷ দুনিয়া কত এগিয়েছে কেউ না কেউ ঠিক করে বলতে পারবে কি হয়েছে৷’

‘অসাধারণ বলেছেন আপু বাই দা ওয়ে আপনার চা টা বেশ হয়েছে৷ কথাটা অবস্য বানিয়ে বল্ল অকিল৷ চা টা জঘন্য৷ কিন্তু প্রশংসায় বেশ লজ্জা পেলেন উনি৷ ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গেল৷ সাগর কারো দিকে তাকাচ্ছে না দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে৷ মানুষ লুকোতে চাইলে এমন করে৷ চোখের দিকে তাকায় না৷ চোখ অনেক কিছু বলে দেয়৷ তিনজনের কথা বার্তা আরো দুই ঘণ্টা চল্ল৷ যখন ওরা পৌঁছুল অকিলের শরীর বেশ ভাল লাগছে৷ রীতিদের বাড়িতে যেয়ে জাবেদ সাহেব কে পাওয়া গেল না৷ তবে রীতির দাদা কে পাওয়া গেল৷ তিনিই নিয়ে গেলেন রীতির রুমে৷ ভীষণ রোগা একটা মেয়ে বিছানায় পড়ে আছে শরীরে একটা কম্বল দেয়া৷ অকিল জিজ্ঞেস করল হাত পা বেধে রেখেছেন ? 

‘হ বাবা, করুম, কিছু করার নাই৷ গত রাতে এক ছোট বাচ্চার গলা টিপা ধরেছে , আল্লাহ্‌ সহায় নাইলে বাচ্চাটা রে বাঁচানো যেত না৷’

‘আজ কত দিন হল এমন?’

‘বাবা ২ মাস ১৭ দিন’

‘জাবেদ সাহেব আসবে কখন বলতে পারেন?’

‘তার আসতে বাবা আজ সন্ধ্যা হবে’

‘ওনার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিল’

‘অবশ্যই কথা হবে, তুমি এ বাড়ির মেহমান আমার নাতনীকে দেখতে আহিস৷ আজ রাতে তোমরা তিনজন থাইক্কা যাও৷ যত্ন আত্তির কোনো কমতি হবে না৷’

বুড়োর কথায় রাজি হল অকিল৷ যেই কথা সেই কাজ৷ বিদেশ ফেরত কোনো মানুষের বোধয় অনেক কদর এদেশে৷  দুই পদ এর মুরগী , খাসি, পোলাও, চার পদের মাছ দিয়ে খাবার দেয়া হল৷ এত খাবার কি মানুষ খেতে পারে ? মনে মনে এটা ভেবে আশ্চর্যিত হল৷ এভাবে আশা আর থাকা টা ঠিক হচ্ছে কিনা তা ও এখন ভাবাচ্ছে অকিল কে৷ সে কোনো ডাক্তার না, না কোনো ফকির বা ওঝা৷ মেয়েটাকে সারানোর কোনো ক্ষমতা ওর নেই৷ নিজের কিউরিসিটি থেকে এসেছে৷ গ্রামে মানুষের ঢল পড়ে গেছে অকিল কে দেখতে৷ বিদেশ ফেরত মানুষের মাঝে কি আলাদা আছে ও বুঝতে পারল না৷ এত খাবার এর কিছুই খেতে পারল না ও৷ অতি শোকে পাথর আর অতি খাবারে অভুক্ত৷ 

এর মাঝে রীতি  এর হাত পা থেকে সেঁকল খোলা হল, গরম পানি দিয়ে তার সাড়া শরীর মোছা হল, নোংরা জরাজীর্ণ কাপড় খুলে ভাল পাড় পড়িয়ে দেয়া হল৷ খাওয়ার পর্ব শেষ করে অকিল এসে মেয়েটার পাশে বসল৷ মেয়েটার কব্জিতে হাত দিয়ে পাল্স দেখল৷ পাল্স বেস ধীর গতির৷ তার পর মেয়েটার চোখ পরীক্ষা করল৷ চোখের পাতার উপর দিয়ে বোঝা গেল ভেতরে চোখের মনি নড়ছে৷ তার মানে মেয়েটা স্বপ্ন দেখছে৷ ব্যাপার টা ইন্টারেস্টিং মনে হল  অকিলের৷ কতক্ষণ এমন মনি নড়ে খেয়াল করতে হবে৷ স্বপ্নের দৈর্ঘ্য কত তা বোঝা দরকার৷ পুরোটা সময় ই কি স্বপ্ন দেখে নাকি মাঝে মধ্যে এটা খুব জরুরী৷ যদিও অকিল ডাক্তার না কিন্তু ও পরিষ্কার বুঝল মেয়েটার সমস্যা খুব জটিল৷ বাংলাদেশের কোনো ডাক্তার কিছু করতে পারবে বলে ওর তেমন কিছু মনে হল না৷ কি করা যায় ভেবে ও ঠিক করল যে করেই হোক অস্ট্রেলিয়াতে ফোন দিতে হবে৷ ওর পরিচিত এক ডক্টর আছে ওকে বল্লে বই টই ঘেঁটে কিছু একটা বের করতে পারবে৷ ঢাকায় গেলে ও হয় তবে ঘুমের উপর অত সুনির্দিষ্ট বই কি পাওয়া যাবে? উহু, তার চেয়ে ভাল বোধয় ইন্ডিয়া গেলে৷ কি করবে বুঝতে পারছে না অকিল৷ পুরো গ্রামে একটা চাপা ভয় দেখা যাচ্ছে৷ কিছু কিছু মানুষ কে দেখা গেল কানা ঘুষা ও করতে৷ রীতি কে গ্রাম থেকে বের করে দেয়ার জন্যেও কিছু লোক চেষ্টা চালাচ্ছে মনে হল৷

সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর জাবেদ সাহেব এলেন৷ উনি বিশেষ খুশি বলে মনে হলো না অকিল এর৷ ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক৷ এমন না যে অকিল কোনো ডাক্তার৷ সাংবাদিকতায় পড়া লেখা করে নিশ্চয় একজন আড়াই মাস ধরে কেন ঘুমাচ্ছে আর কেন এমন আচরণ করছে তা বলতে পারবে না৷ তবে অকিল এর নিজের প্রতি এতটুকু বিশ্বাস আছে যে ওর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এই গ্রামে যে কারো থেকে বেশি হবে৷ 

‘ভাই আমি জানি আপনার আমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা বা ধৈর্য কোনো টাই নাই৷ কিন্তু আমি এতটুকু বলতে পারি আপনি এখন যে সাগরে আছেন তার কূল কিনারা না করতে পারলে ও কিছু টা আশা দিতে পারি৷ আমার কিছু জিনিস জানা খুব প্রয়োজন, আপনি যদি রাজি থাকেন আমি প্রশ্ন করব’

‘জী বলেন’

‘প্রথমেই আপনাকে বলি, আপনি খুব খুব গভীর ভাবে চিন্তা করে আমাকে উত্তর গুলো দিবেন, একদম বুঝে শুনে আপনার অপ্রিয় উত্তর হলেও আপনার সঠিক এবং সুচিন্তিত উত্তর আমার চাই৷ প্রথম যেদিন রীতির এমন হল সেদিন কি হয়েছিল৷’

‘ওর মা যেদিন মারা গেল সেদিন দুপুরে ওর কান্না না থামাতে পেরে আমি ওকে একটা চড় দেই৷ ও কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যায়৷ তার পর তো আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন৷’

‘জী, আচ্ছা গত দেড় মাস আগে যে মেয়েটা আবার এমন ঘুমিয়ে পড়ল সেদিন ও কি আপনি ওকে মেরেছিলেন?’

‘জী না ভাই, তবে আমি তাকে বকা দিয়েছিলাম৷ আপনি নিশ্চয় জানেন সে প্রায়ই আবোল তাবোল বকে৷ যেমন প্রায়ই বলে মা কে এনে দাও, মা ভুতের গালে৷ অনেক দিন তো হলো বলেন! আর কত সহ্য করা যায়? মানুষের কি কেউ মরে না? তাই বলে এমন করতে হবে ?’

‘এমন বকা কি আপনি তাকে প্রায়ই দেন?’

কথা টা শুনে বেশ বিরক্ত হলেন জাবেদ সাহেব৷ উত্তর দিলেন 

‘জী প্রায়ই দেই’

উত্তর টা জী না হলে অকিলের জন্য খুব ভাল হত৷ কিন্তু অকিলের কিছু করার নেই৷ দুনিয়ার নিয়ম ই হচ্ছে সব কিছু কঠিন করা৷ আপনি যদি একটা ব্যাগ থেকে একটা পেন্সিল নিতে চান  আর সেই ব্যাগ এ যদি তিন টা পেন্সিল থাকে তাহলে আপনি যেই পেন্সিল টা চাচ্ছেন সেটাই সবার পরে উঠবে৷ এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু কেন এমন হয় ? ব্যাপার টা নিয়ে অনেক ভেবেছে অকিল৷ এখনো কোনো কূল কিনারা করতে পারে নি ও৷ 

আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বকা দেয়ার সাখে এই গভীর ঘুমের সংযোগ আছে, আবার তার বিরুদ্ধে ও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে৷ ব্যাপার টা ভাবিয়ে তুল্ল অকিল কে৷ পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল অকিল, ওর পা দুটো বেশ দ্রুত দুলছে, যখন ও অনেক বেশি চিন্তা করে তখন ওর এটা হয়  

‘আপনার কি মনে হয় জাবেদ সাহেব আপনার মেয়েকে জীনে ধরেছে?’

‘আমি জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না, আল্লাহ্‌ এর মাল সে যদি এখন তাকে নিয়ে ও যায় আমার আর কিছু বলার নাই’

একটা বাবা তার মেয়ের মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও নিস্তার চায় ব্যাপার টা এই পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে খুব দুঃখজনক  মনে মনে ভাবল অকিল৷  

‘আপনার স্ত্রী সম্পর্কে বলুন। তার সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?’

‘কেমন ছিল বলতে?  কি বলতে চাইছেন?’

‘আমি শুনেছি আপনার স্ত্রী যেদিন মারা যায় সেদিন ও আপনারা ঝগড়া করেছিলেন, আমি জানতে চাচ্ছি এরকম কি প্রায় এ হতো?’

‘ছোট খাটো ঝগড়া সব সময় লেগে থাকতো সেটা বলতে পারেন। সেটা তো সব ঘরেই হয়।’

‘আপনি কি বলবেন যেদিন উনি মারা গেল সেদিন সাধারণ থেকে ঝগড়ার মাত্রা বেশি ছিল?’

‘জী না’

‘আপনি ভেবে বলছেন তো?’

‘জী’

লোকটার কথায় ভরসা পেলো না অকিল। আবার প্রশ্ন করল 

‘আপনার প্রয়াত স্ত্রী এর বাবা বাড়ি কোথায়?’

‘অষ্টগ্রাম’

‘আচ্ছা জাবেদ সাহেব আপনার বউ কি কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করতেন?’

‘জী না, তবে ঘুমের মাঝে মাঝে মধ্যে চিৎকার করত।’

‘সব সময় মন খারাপ বা উদাসীন থাকতো?’

‘উদাসীন এর কথা বলতে পারব না, আমি ঘরে এসে সব সময় দেখতাম সে রান্না করে রেখেছে, টাকা পয়সা এর ভালো হিসাব ছিল, বাসা বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকত, আমার বাবা মা এর ভীষণ সেবা করতো, আমার মেয়ের খুব ভালো যত্ন নিতো। সুতরাং উদাসীন ছিল বলে যাবে না। তবে তার মন প্রায় ই খারাপ থাকতো। হটাৎ হটাৎ রেগে যেতো। 

অকিল মনে মনে ঠিক করল উনার বউ এর বাড়ী যাওয়া টা জরুরী এবং কাল ই যাবে বলে ঠিক করল। জাবেদ সাহেব ক্লান্ত তিনি চলে গেলেন৷ অকিল ঠিক করল আজকে সারা রাত ও মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণে রাখবে৷ সাথে করে কিছু জিনিস নিয়ে এসেছে অকিল৷ একটা রেকর্ডার,  সাথে বেশ কয়েকটা ব্ল্যাংক টেপ৷ অকিলকে একা থাকতে দিতে রাজি নয় সাগর৷ রীতিমত ভয় পাচ্ছে ও৷ নয় বছরের একটা মেয়ে পুরো গ্রাম শুদ্ধ মানুষ তাকে ভয় পাচ্ছে ব্যাপার টা একই সাথে খুব উদ্ভট আর কষ্টের মনে হল অকিল এর৷  

গ্রামের বাড়িতে রাত ১০ টা অনেক রাত, অকিলের সাথে রীতির রুমেই বসে আছে সাগর৷ রীতির জন্যে আলাদা একটা রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ সাধারণত নিয়ম করে রুমে এক-দু জন মানুষ থাকে৷  চোখ দুটো বড় বড় করে একটা উপন্যাস পড়ছে সাগর৷ পায়চারি করলে ওর মাথা ভাল কাজ করে, অকিল তাই রুমে পায়চারি করছে৷ আর একটু পরপর রীতির পালস চেক করছে, মিনিটে কয়বার শ্বাস নিচ্ছে তা ও দেখছে৷ রাত ১২ টা পর্যন্ত তেমন কিছু হলো না৷  ১২ টার পর হঠাৎ দেখা গেল রীতি একটু নড়া চড়া করছে৷ সাগর ও খেয়াল করল বেপার টা৷ বইটা পাশের চেয়ার এর হাতলে রেখে উঠে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো ও৷ 

‘বন্ধু জেগে উঠবে নাকি? নাকি ঘুমের মাঝে সব কিছু খাওয়া শুরু করবে ? ভয় লাগছে বন্ধু কি করব?’

‘পর্যবেক্ষেন বন্ধু এই মূহুর্তটির জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম৷’ 

‘বন্ধু মানুষজন ডাকব?’

সাগরের কথা শুনল, নাকি পাত্তা দিল না অকিল, বোঝা গেল না৷  রীতির হাত ধরে ওর পালস দেখছে অকিল৷ মেয়েটার নড়াচড়া বাড়ছে৷ একটা গোঙ্গানির শব্দ আসছে ওর গলা দিয়ে৷ অ অ প্রথমে চিকন তার পর সেটা  মোটা হচ্ছে৷ এভাবে মিনিট তিনেক চল্ল৷ একটু পর খেয়াল করল গোঙ্গানোর শব্দ বদলে গেছে মেয়েটার৷ রীতি পায়জমা এর নিচে হাত ঢুকিয়ে দিল৷ এবার মুখের ভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল রীতির৷ কোমল-মতি ৯ বছরের বাচ্চাটাকে এখন একজন পূর্ণ বয়স্ক যুবতী মনে হচ্ছে৷ রীতির মুখে আস্তে আস্তে হাসি ফুটে উঠল৷ চোখ দুটো এখনো বন্ধ আছে৷  আস্তে আস্তে হাত টা নিচে নেমে যাচ্ছে৷ পরিস্থিতি দেখে সাগর বা অকিল কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না৷ দুজনই লজ্জায় পড়ে গেছে৷ রীতির হাত টা পায়জামার ভেতর চলে গেল এবার মুখের ভাষা আরো পরিবর্তন হল৷ হাসিটা এবার কঠোর হচ্ছে৷ ঠোট দুটো ফাকা হয়ে গেছে৷ যেভাবে হঠাৎ শুরু হয়েছিল সব কিছু সেভাবেই থেমে গেল সব কিছু৷ নিস্তব্ধ নীরবতা৷ গোঙ্গানি টা এখন আর নেই৷ সাগর কে টান দিয়ে একটু দূরে এল অকিল৷ কিছুক্ষণের মাঝে দেখল মেয়েটা উঠে বসছে৷ তার চোখ আধো খোলা আধো বন্ধ৷ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা ঘুমাচ্ছে৷ একটা তন্দ্রার একটা আবেশের মাঝে আছে৷ সেভাবেই উঠে দাঁড়াল রীতি৷ উঠে বেশ অনেক্ষন দাড়িয়ে থাকলো৷ যে কেউ দেখলে ভাববে যেন একটা মূর্তি৷ এক দন্ড নড়লো না৷ ঘাড় টা ডান দিকে একটু হেলে আছে৷  এভাবে প্রায় মিনিট বিশেক কেটে গেল৷ তারপর  ধীরে ধীরে দরজার দিকে আগাল রীতি৷ সাগর কে ইশারায় কিছু না করতে বল্ল অকিল৷ হাটতে হাটতে যেয়ে দরজার সাথে ধাক্কা খেল রীতি৷ একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল মেয়েটা৷ তার পর একটু পিছিয়ে আবার আগাতে গেল, দরজায় রীতি আবার বাড়ি খেল৷ মেয়েটা এবার আবার পেছাল আবার আগাল ফলাফল একই৷ এবার হাত দুটো  উপরে তুলে ফেল্ল রীতি৷ আস্তে আস্তে মাটিতে বসে পড়ল৷ বসে হঠাৎ হিংস্র পশুর মত দরজা কামড়ে ধরা চেষ্টা করল৷ পারল না৷ এর পর নিচু হয়ে গেল৷ কাচা মাটির ঘড়ের মেঝেতে বড় বড় থাবা দিয়ে শুরু করল মেয়েটা খুবলে মাটি তুলে খাওয়া শুরু করেছে মেয়েটা৷ 

ঘটনাটা দেখে সাগরের পা দুটো কাঁপছে রীতিমত৷ অকিল সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখল সাগর দু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আছে৷ ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে৷ অকিলের দিকে চোখা-চোখি হতেই সাগরের চোখে পরিষ্কার ভয় লক্ষ করল অকিল৷ ওর নিজের ও যে খুব একটা সুবিধের  ঠেকছে পরিস্থিতি তা নয়৷ আর বসে থাকা যায় না৷ পাশেই টেবিলে এক ডজন কলা আর এক ঝুড়ি গুঁড়ের পিঠা৷ অকিল খুব ধীর গতিতে সেগুলো নিয়ে এল৷ আসতে আসতে একটা কলা ছুলে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিল৷ মেয়েটা লক্ষ করল না৷ অকিল বুঝতে পারল ও ভুল করছে ঘুমে মানুষ দেখে না কিছু৷ ও একটা কলা ছুলে মেয়েটার হাতে গুজে দেয়ার চেষ্টা করল৷ কলাটা মাটিতে পড়ে গেল কি করবে বুঝতে পরছে না ও৷ পরে যেখানের মাটি খুবলে তুলছিল মেয়েটা সেখানে  পিঠার ঝুড়িটা রেখে দিল৷ এতে কাজ হল, মেয়েটা গোগ্রাসে পিঠা গুলো মুখে ঠেসে ধরছে৷ মুখ ভর্তি পিঠা গিলতে পারছেনা মেয়েটা তবু যেতে যেতে ঢোকাচ্ছে মুখে৷ আঙ্গুল দিয়ে  মানুষ কে ডাকতে ইশারা করল অকিল৷ সাগর খুব সন্তর্পণে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল৷ অকিলের খালা, দাদা আর বাবা কে নিয়ে এল সাগর৷  এক ঝুড়ি পিঠা ১০ মিনিটে নিজের চোখে শেষ হয়ে যেতে দেখল অকিল৷ মেয়েটার বয়স মাত্র নয় বছর এত গুলো পিঠা সামলাতে পারবে কিনা ভাবছে অকিল৷ পিঠা গুলো শেষ হওয়ার সাথে সাথে মেয়েটাকে পেছন থেকে ধরে বিছানার দিকে নিয়ে যেতে ইঙ্গিত দিল অকিল৷ রীতির খালা সেই চেষ্টা করে পারলেন না৷ মেয়েটা এখন অনেক জোরে জোরে চিৎকার করছে৷ 

‘মমিন, তোরে ছাড়ব না৷ তোকে ছাড়ব না মমিন্নার বাচ্চা৷ আমার মা কে ফেরত দে কুত্তার বাচ্চা৷

রীতির খালা পারলেন না৷ শেষে ওর বাবা ওকে পেছন থেকে ধরে ফেল্ল ওর দাদা ওর দুই পা ধরে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল৷ ওদিকে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে আরো কয়েক জন মহিলা উঠে এলো৷ ওদেকি অকিল দেখল সাগর দুয়া দুরুজ পড়া শুরু করেছে৷ রীতির দাদা ও তাই  শুরু করল৷ রীতির খালা ধরতে যেয়ে ঘুষি খেয়েছে তার ঠোট কেটে রক্ত পড়ছে৷ অনেক্ষন ধরে রাখায় আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসল। অকিল জগ থেকে পানি নিয়ে রীতি এর মুখে শুয়ে থাকা অবস্থায় ই ঢেলে দিলো অনেক তৃষ্ণার্ত মানুষের মতো টানা তিন দুই গ্লাস পানি খেয়ে গেলো। দিলে হয়তো আরো খেত, কিন্তু অকিল আর দিলো না। 

ছয়

সেদিন রাতের পর সোজা জাবেদ সাহেবের বউ এর বাড়ি হয়ে ঢাকায় চলে এলো অকিল। জাবেদ সাহেবের স্ত্রী এর নাম রিশিতা।  রিশিতা দের বাড়ি খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হলো। ঐ নামে রিশিতা কে খুব কম মানুষ জানে বলে মনে হল। নিশ্চয় অন্য কোনো ডাক নাম আছে এটা প্রথমে ভাবলেও পরে রিশিতার ভাই জানালেন ওর নাম রিশিতা বেগম।  আর কোনো ডাক নাম নাই। তাহলে মানুষ কেন তাকে ঐ নামে চিনে না বোঝা গেলো না। ঢাকার পল্টনে একটা হোটেলে উঠেছে অকিল। কিছু জিনিষ এর লিস্ট করে ফেললো ও ভুলে যাবার আগেই। রিশিতা রা এক ভাই এক বোন। ওদের বয়স এর পার্থক্য দুই বছর, ভাই তা বড়। রিশিতার ছবিতে তাকে খুব ডিপ্রেস দেখাচ্ছে (নোট: ছবিতে অন্তত আমরা হাসি খুশি থাকি, তার মানে এটা বলাই যায় রিশিতার চূড়ান্ত রকম ডিপ্রেশন ছিল)   অকিল এর এই যুক্তি তার ভাই ও সমর্থন দিল। রিশিতার বাবা মা কেউ বেঁচে নেই, বিয়ের দুই বছরের মাজে দুই জন এ মারা যান। রিশিতার বংশে মানুষিক সমস্যা বা জিনে ভুতে ধরার কোনো রেকর্ড পাওয়া গেলো না। রিশিতার বাবার বংশে ও এমন কোনো রেকর্ড পাওয়া যায় নাই। ছোটবেলায় রিশিতা অনেক বই পড়তো। সাধারণত সব বাংলা উপন্যাস যেমন রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ুন আহমেদ, সমরেশ, সত্যজিৎ এগুলা। বেশ কিছু ইংরেজি বই ও পাওয়া গেল, বেপারটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগল অকিলের কাছে।  এই অজ-পাড়া গা যে জেন অস্টিন, শেক্সপিয়ার, শার্লক এর ইংরেজি অরিজিনাল বই পাবে কখনো ভাবেনি অকিল। এমন কি ডাক্তারি বিদ্যার কিছু বই ও পেয়েছে অকিল। সব গুলোই  আসল বই এবং অনেক পুরানো বই।  বেশ অবাক হলো অকিল, ওর ভাই কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল উনার বাবা ইংরেজি এর শিক্ষক ছিলেন, পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া বেশ সম্পত্তি থাকায় ওদের আর্থিক অবস্থা ভালোই ছিলো । মেয়েকে উনি পড়ালেখার জন্যে দার্জিলিং পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ওখানে আর পড়া লেখা করা হয়নি ওর৷ দুই বছর পর ওর বোন চলে আসে৷ পাহাড়ি এলাকা পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিল মেয়েটা৷ যদিও ওর ভাই এর মতে ব্যাথা টা কোনো গুরুতর কিছু না, শরীরে সামান্য ছাল চামড়া গিয়েছিল৷ কোনো হাড় ভাঙ্গা বা মাথায় আঘাত তেমন কিছুই না৷ এর পর দেশে থেকেই অনার্স পাস করে ওর বোন। এর পর পর এ জাবেদ সাহেবের সাথে বিয়ে হয়। বিয়েটা ওর বাবা মা এর ইচ্ছা তেই হয়। বোনের মতামত ছিল কেন জানতে চাইলে রিশিতার ভাই তেমন কিছু বলতে পারলো না। আরো একটা জিনিষ জানা গেল তা হলো রিশিতার পড়ালেখার প্রতি ঝোঁক বিশেষ করে গল্প উপন্যাস এমন কি মেডিক্যাল আর বোটানি এর বই এর উপর বেশ আগ্রহ ছিল। রিশিতার বিয়ের পরপর একবার অনেক বড় একটা ঘূর্ণিঝড়ে অনেক বই নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় তিনশো এর উপর বই ছিল। অকিল যা দেখে এসেছে তাতে বোঝা যায় প্রায় একশো এরমত বই এখন ও টিকে আছে। ডাক্তারি বই গুলির মঝে একটা ইংল্যান্ড আর একটা কলকাতার লাইব্রেরি এর সিল দেওয়া।  বই গুলোর নাম যথাক্রমে  

Hallucinations or, the rational history of apparitions, visions, dreams, ecstasy, magnetism, and somnambulism লিখেছেন Brierre de Boismont, Alexandre-Jacques-François

Comprehensive Textbook of Psychiatry, II, Volume 2

লিখেছেন : Alfred M. Freedman, Harold I. Kaplan, Benjamin J. Sadock

অকিল একটা বিশাল সমস্যা হলো যেকোনো বই পড়ার আগে ভীষণ নার্ভাস লাগে আর বই গুলো যদি হয় মেডিক্যাল বই তাহলে তো কোথায় নাই। অকিল বই গুলো সযত্নে ওর ব্যাগ এ গুছিয়ে রেখে দিলো। পল্টনে দেশ এর বাইরে ফোন করা যায় এমন একটা দোকান খুঁজে বের করল অকিল, অস্ট্রেলিয়া এর সেই ডাক্তার কে পাওয়া গেল না আরো দুঃখের বিষয় সেই হাসপাতাল র এক নার্স ওর পরিচিত ছিল তাকে ও পাওয়া গেলো না। দুইজনকেই একসাথে না পাওয়া যাওয়া খুবি রহস্য জনক ঠেকলো অকিল এর কাছে। কোথায় গেছে তাদের কবে পাওয়া যাবে তা ও বুঝা গেল না। শুধু এটুকু জানা গেল যে ডাক্তার প্যারিস এ বেড়াতে গেছে। যা বুঝার বুঝে গেল অকিল। নিশ্চয় ডাক্তার বেটা সেই নার্স কে বিয়ে করে এখন মধু চন্দ্রিমা তে ব্যস্ত আছে। ওদের জন্যে অকিলের খুব ভালো লাগলেও ওর সমস্যার সমাধানের কোনো কুল কিনারা পেল না ও। ওদিকে দেশ এর নামকরা ডাক্তারদের দেখা পাচ্ছেনা ও। তাদের সময় এই নেই। অনেক কষ্টে শিষ্টে ওর সাথে এক বাঙালি থাকতো যার বাবা এখানকার এমপি। এমপি এর ছেলে কে বলে তার বাবা কে দিয়ে এক নামকরা ডাক্তার এর কাছে এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেলো। 

ডাক্তার এর চেম্বারটা ধানমন্ডি আট নম্বর এ। ঢাকা শহর চেনে না অকিল। এর আগে মাত্র একবার এসেছে ও ঢাকায় তাও সেটা ছয় বছর আগে তাই ডাক্তার এর চেম্বার খুঁজে পেতে খুব কষ্ট হয়ে গেল অকিল এর। 

ডাক্তার সাহেবের মাথায় ঝাঁকড়া চুল, উনি একটা পাঞ্জাবি পড়ে আছেন৷ উনাকে দেখলে মনে হয় উনার শরীর দিয়ে তেল বেয়ে পড়ছে৷ চেহারা কেমন জানি অদ্ভুত৷ চেম্বারে সেই পরিচিত ডেটল বা স্যাভলন কিছু একটা হবে তার গন্ধ৷ 

‘জী বলুন কি সমস্যা’

‘স্যার, সমস্যা টা আমার না, আমার এক পরিচিতের’

‘রোগী কোথায় ভেতরে নিয়ে আসুন’

‘স্যার রোগী তো ঘুমিয়ে আছে, তাই আনা যায় নি, সে গ্রামে থাকে৷’

ডাক্তারের মুখটা এবার কাল হয়ে গেল, তার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেল৷

‘তিনি একটা কলিংবেল টিপলেন’

ভেতর থেকে দৌরে একজন পিয়ন ঢুকল ডাক্তার এর চেম্বার এ

‘এই এটার সাথে কেউ এসেছে?’

‘স্যার জী না স্যার’

এবার অকিল এর অবাক হওয়ার পালা, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝে ও ব্যাপার টা বুঝতে পারল৷ অকিল ডাক্তার কে বল্ল 

‘সার আপনে আমাকে পাগল ভাবছেন বেপারটা একদম ই নিছক ভুল বুঝাবুঝি৷ আমি যে রুগী হয়ে এখানে এসেছি সে গত দুই মাস উনিশ দিন ঘুমাচ্ছে । তাই আমি আপনাকে বলছি রুগী ঘুমচ্ছে ।’

এবার অবাক হওয়ার পারা ডাক্তার এর,  তিনি হলেন।

‘দুই মাস উনিশ দিন ধরে ঘুমাচ্ছে? আপনে আমার সাথে ফাজলামো করেন?’

কথাটা শুনে মোটেই অবাক হলো না অকিল । ডাক্তার এর চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসলো অকিল । প্রচণ্ড শীত এ  কাঁপছে ও । রাত এখন আটটা  বাজে। ঢাকার রাজ পথে  যেন বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে । কাঁপতে কাঁপতে যেয়ে একটা টং এর দোকানে  ঢুকল ওকীল । 

‘চাচা চা তো হবে না?’

‘হ বাবা কেন হবে না অবশ্যই হবে ।’

‘চাচা অদা দেন চিনি দিয়েন অল্প করে, যদি ধরেন আধা চামচ চিনি ।’ 

কিছুক্ষণের মাঝেই চা এল৷ অকিল এক কাঁপ চা ই অনেক্ষন ধরে খেল৷ আজ পথে ঘাটে মানুষ নেই৷ সম্ভবত প্রচন্ড শীতের কাড়নে মানুষ খুব জরুরী কিছু না হলে বের হচ্ছে না৷ অকিলের মাথায় কিছু ঢুকছে না৷ কি করা যায় কই যাওয়া যায়৷ এসব ভাবতে ভাবতে ও চা ওয়ালাকে বল্ল৷

‘চাচা আপনাকে একটা প্রশ্ন করতাম, কিন্তু যে প্রশ্ন টা করতে চাচ্ছি সেটা মানুষ কে করা অভদ্রতা, তাই আপনার কাছে অনুমতি চেয়ে নিচ্ছি৷ আপনি অনুমতি দিলে আমি জিজ্ঞেস করব’

চাচা মিয়া কিছুটা অবাক হলেন৷ জীবনে তাকে কেউ এত সম্মান করে নাই৷ তার নিজের কাছে খুব ভাল লাগল ব্যাপার টা৷ একজন মানুষ তাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবে তার জন্য অনুমতি চাইছে৷ 

‘বাবা নির্দ্বিধায় করতে পার’

‘চাচা আপনে সারা দিনে কত টাকা রোজগার করেন?’

চাচা বেশ অবাক হলেন এটা জিজ্ঞেস করার জন্য অনুমতি নিল?

‘বাবা দিনে প্রায় দুইশ টাকার মত রোজগার হয়৷ হেয়ানে ধর আশি টাকার মত লাভ হয়৷ এই আরকি৷’

‘চাচা আপনাকে আমি দিনে তিন শত টাকা করে দিব৷ তিন বেলা খাওয়াব৷ আপনে আগামী এক সপ্তাহ আমার সাথে থাকবেন৷ আমারে চা করে খাওয়াবেন৷ চা এর চা পাতি, চিনি আর যা লাগে সবই আমি দিব কি বলেন?’

এবার চাচা বেশ অবাক হলেন বলে কি ? এ তো পুরা চা খোর৷ উনার রাজি না হওয়া কোনো কারণ দেখলেন না৷ অকিল চাচা কে নিয়ে রওনা হলেন৷ 

সাত

আজ সকাল থেকে প্রথম বইটা নিয়ে বসেছে অকিল৷ বেশ ইন্টারেস্টিং বই৷ অনেক কিছুই ও বুঝতে পারছে না৷ যখন বুঝতে পারছে না মেডিকেল রিলেটেড টার্মিনলজির ডিকশনারি দেখছে৷ তিন চার রকমের ডিকশনারি নিয়ে বসেছে অকিল৷ এক একটা পাতা শেষ হতে অনেক সময় লাগছে৷ ও বুঝতে পারল এভাবে পরে গেলে হবে না৷ একটা বুদ্ধি করল ও৷ পুরো বইটা না পরে ঠিক করল দ্রুত ওয়ার্ড গুলোতে চোখ বুলিয়ে যাবে৷ কোথাও কোনো ইন্টারেস্টিং কিছু পেলে আগে পিছে পড়ে দেখবে৷ অকিল ধারনা করছে রিশিতার ও তার মেয়ের মত একই সমস্যা ছিল৷ আকিলের মতে রোগ টা বংশগত৷ আর তাই হয়তো রিশিতা বই গুলো আনিয়েছিল তার রোগ সম্পর্কে পড়ালেখা করতে৷ তবে এই বইগুলোতেই যে কিছু পাওয়া যাবে তার কোনো গ্যারান্টি নাই৷ অকিল নিজে এমন অদ্ভুত রোগের কথা শুনে নাই৷ এমন কি যে বিখ্যাত ডাক্তার এর কাছে গিয়েছিল অকিল সে পর্যন্ত কিছু জানে না এই সম্পর্কে৷ রিশিতা  এই বিষয়ে যদি কোনো বই যদি কখনো পেয়েও থাকে হয়তো ঘূর্ণি ঝড়ে সেই বই গুলো নষ্ট হয়ে গেছে৷ আবার হতে পারে এই বইগুলোতে কিছু আছে যা ওকে সাহায্য করবে৷ 

টানা সাত ঘণ্টায় বইটা ঘাটার  পর অকিল ভাবল আর শরীরে কুলচ্ছেন একটু বিশ্রাম খাওয়া দাওয়া দরকার৷ এদিকে চা ওয়ালা চাচা ও হাঁপিয়ে উঠেছেন, গত সাত ঘণ্টায় উনি প্রায় ৪০ কাপ চা আনিয়েছেন৷ অকিলের খুধা নাই, থাকার কথা না৷ এত চা খেলে কারো ক্ষুধা ধাকে না৷ অকিল স্নান করে আসল৷ এসে কিছুক্ষণ আজকের দিনের পত্রিকা কিছুক্ষণ ঘাটা ঘাটি করল৷  তার পর পিজি হাসপাতালের লাইব্রেরিতে কতক্ষণ সময় কাঁটালো৷ নিউরোলজি আর ঘুম রিলেটেড সমস্যার কিছু বই খুঁজে বের করল৷ সেই বই গুলো থেকে লেখকদের নাম যোগাযোগ এর ঠিকানা বের করল৷ যোগাযোগ করে পাবলিশার দের ঠিকানা পাওয়া গেল৷ দুটো পাবলিশার এর ফোন নাম্বার দেয়ে আছে৷ তাদের অকিল ফোন করে রাইটার দের চিঠি পাঠানোর ঠিকানা চেয়ে নিল৷ এক জনের টা পাওয়া গেল আরেকজনের তা দিতে অস্বীকৃতি জানাল পাবলিশার৷ 

হোটেলে ফিরে এসে অকিল খুব মনোযোগ দিয়ে মোট ৫ টা চিঠি লিখল৷ একই কথা সব চিঠিতে৷  পল্টনের এই হোটেলের ঠিকানায় যোগাযোগ করতে বল্ল৷ চিঠি টা নিম্নরূপ 

জনাব, 

প্রথমেই ধন্যবাদ আমার চিঠি পড়ার জন্য সময় বের করার জন্য৷ আমি জানি আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ তাই কাজের কথায় যাচ্ছি সরাসরি৷ 

আমি বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা৷ আমাদের এলাকায় একটি ৯ বছরের মেয়ে গত ২ মাস ১৯ দিন ধরে ঘুমাচ্ছে৷ সে মাঝে মধ্যে তার বাথরুম ও খাওয়াদাওয়ার  প্রয়োজনে আধো ঘুম আধো জাগা একটা অবস্থায়  পৌছায় সেই স্টেটে সে সামনে যা পায় খাওয়ার চেষ্টা করে, ঘুমের সময় তার পাল্স কমে যায়, যতক্ষণ ঘুমে থাকে সে স্বপ্ন দেখে,  আক্রমণাত্মক ব্যবহার করে, তার যৌন কামনা বেড়ে যায় এবং তা প্রকাশ করে , মেয়েটি মাঝে মধ্যে চিৎকার করে৷ গত দুই মাস উনিশ দিনের আগে আরো চার মাস আগে সে  মোট ছয় দিন এভাবে কাটায় তার পর হঠাৎ এদিন সে সম্পূর্ণ ভাল মানুষের মত আচার আচরণ করে৷ মজার বিষয় গত ছয় দিনের কোনো ঘটনা তার মনে ছিল না৷ 

আপনি বুঝতেই পারছেন আমাদের এখানে  ঘুম এর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই৷ তাই আমি বাধ্য হয়ে আপনার কাছে চিঠি লিখিছি আশা করছি আপনি আপনার সুচিন্তিত মতামত প্রদান করবেন৷ আপনি চাইলে আমার কাছে আপনার কনসালটেশন ফি চেয়ে পাঠাতে পারেন৷ আমি আপনার দ্রুত উত্তরের আমায় থাকব৷ 

অকিল

দুটো বই শেষ করতে অকিলের মোট ৯ দিন সময় লেগে গেল৷ চা ওয়ালা চাচা ২ দিন কাজ করে অকিলের কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে গেলেন৷  ৯ দিন পর যখন অকিল বইটা শেষ করে দাঁড়াল তখন ওর মাথা ঘুরছে৷ অকিলের মনে হচ্ছে ওর ওজন কম পক্ষে ৫ কেজি কমে গেছে৷ গত দুই দিনে অকিল বাথরুম ব্রেক ছাড়া আর কোনো কাড়নে উঠে নি৷ শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে ওর৷ কিছু খাওয়া দরকার৷ রুমের কলিং বেল টিপে রুম বয় কে ডেকে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে বল্ল অকিল৷ খাবার দেয়ার সময় ওর কোনো চিঠি এসেছে কিনা খোজ নেয়ার কথা বল্ল৷ 

রুম বয় টা চলে যাওয়ার পর অকিল ভাবল স্নান টা করে নিলে কেমন হয় এর মাঝে৷ অকিল বাথরুমের দরকার সামনে ঠিক তখন ওর মাথা টা ঘুরে উঠল৷ কঠাৎ দেখল পুরো পৃথিবী টা দুলছে৷ বাথরুমের দরজার হ্যান্ডল ধরে ব্যালেন্স করতে চাইল পারল না হঠাৎ মনে হল বাথরুম টা দূরে চলে গেল৷ তার পর খেয়াল করল ওর চোখ দুটো সাদা লাইটে ভরে গেল৷ তার পর সব হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল৷ 

অদিক হোটেল বয় খাবার নিতে এসে অকিল এর রুম ধাক্কা ধাক্কি করে ভাবল রুমের চাবি  এনে খাবার ভেতরে দিয়ে যাই , নিশ্চয় কোথাও গেছে চলে আসবে৷ রুমের চাবি খুলে ছেলেটা দেখল অকিল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে পুরো রুম রক্তের বন্যায় যেন ভেসে গেছে৷ 

জ্ঞান হারানোর ৩ দিন পর জ্ঞান ফিরল অকিলের৷ জ্ঞান ফেরার পর দেখল সাগর ওর দিকে উপুড় হয়ে তাকিয়ে আছে 

‘কিরে, বেচে আছিস তাহলে!’

পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেয়ে বেশ ভাল লাগল অকিল এর৷ মলিন একটা হাসি দিল ও৷ কথা বলতে যেয়ে আবিষ্কার করল মাথায় প্রচন্ড ব্যথা কথা বলতে গেলে সেটা আরো লাগে৷

‘অত সহজে মরে যাব? তোর মেয়ের সমস্যা টা সমাধান করতে হবে না ?’

কথা টা শুনে সাগরের মুখটা কাল হয়ে গেল৷ সাগর ওর কাঁধের এদিকে ওদিকে তাকাল৷ 

‘বলছিস কি তুই, মানে …’

আমতা আমতা করল সাগর৷ অকিল ওর হাতটা সাগরের হাতে রেখে 

‘বন্ধু ব্যাপার না, আমার হাতের স্যালাইন টা খুলে দিতে বলবি ?’

‘স্যালাইন খুলবি? মানে….’ সাগরের সক টা এখনো কাটে নি৷ 

অদিকে জ্ঞান ফিরেছে শুনে দু জন নার্স দৌরে এসেছে৷ অকিলের চোখে লাইট দিয়ে পরীক্ষা করল৷ একটু পর ডাক্তার এলেন৷ 

‘কি ভাই ব্যাপার টা কি বলেন তো? অজ্ঞান হওয়ার আগে কয় দিন না খেয়ে ছিলেন ?’

ইয়ং ডাক্তারের কথা শুনে একটু হাসল অকিল৷ মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর৷ মাথার চুল ছেলেদের মত কাটা৷ বড় চুলে ঝামেলা হয় হয়তো তাই এভাবে কাটা৷ কিন্তু বেশ লাগছে , খারাপ লাগছে না৷ দেখেতে মাঝারি গড়নের শ্যামলা৷ মেয়েটার কথার মাঝে একটু দুষ্টুমি ভাব আছে৷ হেসে হেসে কথা বলছে৷ হাসি টা বেশ৷ কাল রং এর একটা শাড়ি তার উপর সাদা এপ্রন বেশ ভালই রাগছে৷

‘ম্যডাম, কবে যেতে পাড়ব বলেন তো?’

‘ওমা সে কি, পুলিশ ভাই, আপনার বন্ধুর বোধয় আমাকে একদম পছন্দ হয় নি তাই না? যেই আমি এসে কথা বল্লাম অমনি বলে কবে যেতে পারবে৷ এই আমি কি দেখতে এত পচা নাকি ?’

মেয়েটা কথা ও বলে এত সুন্দর করে, মনে মনে ভাবল অকিল৷ মাথার ব্যথাটা এখন বেমালুম চলে গেছে, কিন্তু বুকের বাম দিকে একটা ব্যথা অনুভব করল অকিল৷ সাথে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস৷ তার কিছুক্ষণ পর অকিল ভাবল মানুষের হার্ট তো আসলে বাম দিকে থাকে না, হার্ট টা আসলে  মাঝা মাঝে একটা অবস্থানে থাকে , দুই ফুস ফুস এর মাঝে৷ তাহলে বুকের বাম দিকে কেন মানুষ বলে ? আবার বাম দিকেই কেন ব্যথা টা লাগল?  নাহ মেয়েটাকে আসলে অসম্ভব মনে ধরেছে৷ 

আট

অকিল কে আরো দুই দিন হাসপাতালে থাকতে হলো৷ শেষ দিন সেই ডাক্তার মেয়ে টাকে কথাও খুঁজে পেল না অকিল৷ অন্তত শেষ দেখা টা হোক আশা করেছিল সেটাও হল না৷ তাই অকিলের মন ভীষণ খারাপ, মন খারাপ করে গ্রামের বাড়ি রওনা দিল৷ মন খারাপের আরেকটা কারণ হোটেলে খোজ নিয়ে জানা গেছে ওর নামে কোনো চিঠির উত্তর আসে নি৷ ১৪ দিনে যখন কোনো উত্তর আসে নি আর আসবে না বলেই মনে হচ্ছে অকিলের৷ আর্জেন্ট চিঠি পাঠিয়েছিল যেতে সর্বোচ্চ তিন দিন লেগেছে এর বেশি নয় আসতে না হয় ১০ দিন লাগল তাও তো হয় না৷ গ্রামের বাড়ি পৌছুতে প্রায় সারাদিন ই লেগে গেল রাত ৮ টা নাগাদ পৌঁছুল অকিল৷ 

পরদিন ভোর বেলায় সাগর আর অকিল রওনা দিল রীতিদের গ্রামে৷ আজকে কুয়াশা নেই বল্লেই চলে৷ পানি অস্বাভাবিক রকম শান্ত৷ যেন নড়ছেই না৷ নৌকাটা তাই দোল ও খাচ্ছে না৷ 

‘বন্ধু তুই জানলি কি করে বল্লি না তো’

হাসপাতাল এ এই নিয়ে কথা হওয়ার পর আর কথা হয় নি অকিলের সাথে সাগরের৷ লজ্জায় হয়তো কথা টা আর তুলে নি সাগর৷ 

‘বন্ধু, তুই যখন জিজ্ঞেস করছিস তাই বলি, তবে জেনে রাখ আমি তোকে কোনো খারাপ চোখে দেখছি তা না৷ রীতি যে তোর মেয়ে সেটা বুঝেছি বেশ কয়েকটা কারণে৷ প্রথমে আমি বুঝেছি ওটা জাবেদ সাহেবের মেয়ে না৷ এখন প্রশ্ন হল কি করে বুঝলাম৷ এক, এদের চেহারায় মিল নেই৷ এখন কথা হল চেহারায় মিল না থাকতেই পারে এটা কোনো বড় ব্যাপার না৷ তাহলে আসি দুই নাম্বার পয়েন্ট এ৷ আমি যখন রীতির পাল্স দেখলেম তখন খেয়াল করলাম রীতির বাম হাতের কানি আঙ্গুল টা একটু বাঁকা৷ আমি যখন ওর হাত টা বিছানায় রেখে দিলাম পাল্স দেখে তখন খেয়াল করলাম জিনিস টা৷ সমতল স্থানে রাখলে জিনিস টা খেয়াল হয়৷ বাঁকা টা খুবই সামান্য তেমন কারো চোখে পড়ে না৷ আর তোকে তো আমি অনেক দিন চিনি তোর বাম হাতের কানি আঙ্গুল টা যে অমন আমি জানি৷ ’

‘কিন্তু এতেই তো প্রমাণ হয়না আমি ওর বাবা৷’

‘না না, তা তো হয় ই না, আমি আরো খেয়াল করলাম জাবেদ সাহেবের এই সমস্যা নেই৷ আমি তখন নিশ্চিত হলাম এটা উনার মেয়ে না৷ এখন তুই বলতে পারিস রিশিতার তো থাকতে পারে৷ আমি নিশ্চিত জানি রিশিতার এই সমস্যা নাই৷ ওদের বাড়ি যখন যাই আমি ওদের ফ্যামিলি ছবি দেখেছি ওর ভাই কে জিজ্ঞেস করেছি৷ এখন তুই বলবি ঠিক আছে বাচ্চা টা জাবেদ সাহেবের না কিন্তু তোর কিভাবে বুঝলাম৷ তাই তো ?’

‘হু’ বেশ চিন্তিত দেখাল সাগর কে 

‘সেদিন রাতে তোর মানিব্যাগ টা পড়ে গিয়েছিল বিড়ি বের করতে যেয়ে মনে আছে?’

‘যাহ শালা এখানেই ধরা খেয়ে গেলাম৷’

‘মানিব্যাগ এর ঐ ছবিটা তো রীতির ছোটবেলার তাই না?’

‘হু’

‘রীতির ছোট বেলার একটা ছবি ওর মা এর বাড়ি যেয়ে ওদের পারিবারিক এ্যালবাম এ দেখি তার পরও সব কিছু মিলে নি৷ আমি তখনো ভাবি নি রীতি তোর মেয়ে কিন্তু এটা ভেবেছি জাবেদ সাহেবের মেয়ে না৷ বিশ্বাস করবি না যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম তখন বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন মাথায় অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল৷ আর যখন জ্ঞান ফিরল মনে হল আমি সব জানি৷ এরকম হয় ব্যাপারটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে৷ আচ্ছা ছবিটা কি রিশতাই দিয়েছিল?’ 

‘হু, অনেক চেয়ে টেয়ে আমি ঐ ছবিটা আদায় করেছিলাম রিশিতার কাছ থেকে, ওকে আমি খুব ভালবাসতাম জানিস? বাবা মা এর কথা রাখতে যেয়ে ও জাবেদ কে বিয়ে করে৷ রিশিতা আমার চেয়ে বয়সে ৪-৫ বছরের বড় হবে৷ তাই ওর বাবা মা বিয়েটাতে রাজি হয় নি৷’

‘তোদের ব্যাপার টা জানত তারা?’

‘হু’

‘রীতি এর ব্যাপার টা জানত?’

‘নাহ’

রীতিদের বাড়ি পৌছুতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল৷ গ্রামে পাড়া দিতেই এক বৃদ্ধ চাচা দৌড়ে এলেন৷ 

‘বাবা জীনের আসর ছাড়সে, জীনের আছড় ছাড়সে, তোমারে খুজতেসে, যাও যাও জলদি যাও’

ব্যাপার টা বেশ অবাক লাগল অকিলের৷ অকিলকে চেনার কথা না মেয়েটার৷ ঘুমের মাঝে ওকে দেখা বা নাম জানার কারণ নাই কোনো৷ এবং যদ্দুর ও বুঝতে পারছে ঘুমিয়ে থাকার সময় করা কিছু মেয়েটার মনে থাকে না৷ 

রীতি দের বাসার সামনে অনেক ভীর৷ অকিল আস সাগর সেই ঘড়ে ঢুকল৷ রীতি বসে আছে৷ সে একটা নতুন একটা জামা পড়েছে৷ সেটা সবাই দেখাচ্ছে৷ অকিল কে দেখে মেয়েটা চুপ হয়ে গেল৷

‘মা, তুমি আমাকে খুঁজেছ?’

আশে পাশের মানুষের দিকে তাকাল মেয়েটা, যেন বলতে চাইছে না কথা এত গুলো মানুষের সামনে৷ বুঝতে পারল ব্যাপার টা অকিল৷ 

‘মা চল আমরা ঘাট থেকে একটু ঘুরে আসি, অনেক দিন বাড়ি থেকে বের হও না৷ ভাল লাগবে৷’

রীতির হাত ধরে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাটছে ও আর অকিল৷ আজ বেশ রোদ একটু হাটতেই ঘেমে উঠল অকিল৷ ও চাইছে মেয়েটা কথা বলতে, শুরু করুক কিছু নিজে থেকে বলতে চাইছে না৷ অনেক দূর হাটার পর মেয়েটা এদিক ওদিক তাকাল৷ যেন বোঝার চেষ্টা করল কেউ শুনছে কিনা ওদের৷ যখন নিশ্চিত হল তখন অকিলের দিকে তাকিয়ে ওকে কাছে আসতে বল্ল রীতি৷ অকিল  হাটু ভাজ করে নিচু হল৷ রীতি ফিস ফিস করে অকিল কে বল্ল 

‘আমার মা কে এনে দিবেন?’

অকিলের বুকে মোচর দিয়ে উঠল৷ এতটুকু মেয়ে এত দখলের পর শুধু মা কে চাইছে৷  তার আর কোনো চাওয়া নেই৷ চোখ দুটো টল মল করে উঠল অকিলের৷ 

‘মা, তোমার মা তো অনেক দূরের দেশে চলে গেছে৷ আমরা চাইলেও যোগাযোগ করতে পারব না৷ কিভাবে আনি বল?’ 

‘মা ঢাকায়, ভুতের গালে৷ ঐ যে মোমিন টা আছে না? ও ভাল না৷ মোমিন টা মা কে নিয়ে গেছে৷’

‘ভূতের গালে কি মা?’

‘ভুতের গালে, আরে আপনি বুঝেন না বুঝি৷ আপনি তো ঢাকা থেকে আসলেন একটু আগে৷’

অকিল বেশ অবাক হল 

‘তুমি জান? বাবা বলেছে বুঝি?’

‘না আমি জানি কেউ বলে নি, বাবা তো আপনার কাছে ছিল৷’

এবার বেশ ধাক্কা খেল অকিল৷ সাগরের কেমন লেগেছিল এটা বলার পর ও এখন বুঝতে পারছে৷ মনে মনে ভাবল অকিল

‘বলে কি! সাগর যে ওর বাবা এটা জানে মেয়ে টা ? নাকি ওর জাবেদ সাহেব ঢাকায় গিয়েছিল?’

‘মা তোমার বাবা তো এখানেই ছিল, তোমাকে দেখা শোনা করল’

কথা টা শুনে মেয়েটা তাচ্ছিল্যের সূরে বল্ল

‘আপনার চিঠি গুলো আসবে না৷ ওদের অত টাইম নেই’

অকিলের মাথা টা ঘুরে উঠল এবার, মাই গড৷ মেয়েটা এসব কি করে জানে ? কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না ও৷ 

‘আপনি চাইলে আমাকে আমার মা কে এনে দিতে পারেন৷ আমার আর কারো কাছে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই৷’

কি করবে কিছু বুঝতে পারল না অকিল৷ ওর নিজের ই এখন এই দিনে দুপুরে ভয় ভয় লাগতে শুরু করল৷ মেয়েটা কিভাবে এগুলা জানল৷ অকিল মেয়েটাকে নিয়ে দ্রুত গ্রামে চলে গেল৷ পরে সাগর আর ওর বাবা কে জিজ্ঞেস করল কেউ মেয়েটাকে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলেছে কিনা, জানা গেল ও যে ঢাকায় গেছে মেয়েটাকে বলা হয় নি , চিঠির কথা শুধু সাগর জানত, সাগর ওর সাথেই এসেছে সুতরাং বল্লে অকিল জানত৷ এবং জাবেদ সাহেব ঢাকায় গিয়েছিলেন কিনা এটা ও জিজ্ঞেস করতে ভুল্ল না অকিল৷ কিন্তু তিনি যান নি৷ মেয়েটাকে কি কখনো সাগর বলেছিল যে সাগর ওর বাবা? এমন প্রশ্ন করে সেটার ও উত্তর পাওয়া গেল নেগেটিভ৷ অকিলের মাথা ঘুরছে৷ কি ভাবে জানে মেয়ে টা৷ 

অকিল ঠিক করল একটা মারাত্মক কাজ করতে হবে৷ আগে যেতে হবে মিঠামইন সদর এ৷ প্রায় পাঁচ ঘণ্টার পথ৷ অকিল বল্ল মেয়েটাকে নিয়েই চলুন খুব দ্রুত যা করার করতে হবে৷ ওরা রওনা দিল মিঠামইন এর দিকে  ওর সাথে আছে জাবেদ সাহেব, সাগর, রীতি, রীতির বাবা আরো গ্রামের কিছু মুরুব্বি৷ 

নয়

সকাল ৯ টা বাজে৷ মিঠামইন সদরের দোকান-পাট গুলো খুলতে শুরু করেছে৷ সাগর ঢাকার রমনা থানায় একটা ফোন দিয়ে কিছু ইষ্ট্রাকশন দিল৷ আর অকিল ফোন দিল ওর বন্ধু বাবা এমপি সাহেব কে৷ এমপি সাহেব মাই ডিয়ার মানুষ৷ ছেলের বন্ধু হওয়ায় আবারো কদর করলেন এবং জানালেন কোনো সমস্যা না কাজ টা হয়ে যাবে৷ তবে উনার কথায় অকিল খুব একটা ভরসা পেল না৷ কত মানুষ কে এরা এমন কত কথা দেয় কত গুলো কথা রাখে সেটাই একটা বড় বিষয়৷ 

‘বাবা কাজ টা কি ঠিক হবে?’ জিজ্ঞেস করল রীতির দাদা 

‘চাচা কখনো কখনো অপ্রীতিকর কাজ টা করতে হয়৷ অপ্রীতিকর কাজ টা না করলে যখন নয় তখন তা আর দেরি করি লাভ নেই৷’

মিঠামইন গোরস্থান টা হাওরের পাশেই৷ গ্রামের কিছু মুরুব্বি আর জাবেদ সাহেব মিলে রিশিতার কবর টা বের করা হল৷ সামনে রিশিতা এর নাম ফল টি লাগানো৷ অকিল বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল আপনারা নিশ্চিত তো এটাই ? নাম ফল ও তাদের স্মৃতি তাই বলে৷ কবরস্থান এর খাতায় তো তাই লেখা দক্ষিণ পশ্চিম  দিকে শেষ আইল থেকে ৩ নাম্বার আইলের ৯ নাম্বার কবর রিশিতার৷ সব ই মিলে যায়৷ জাবেদ সাহেব অনুমতি দিলেন৷ কবর খোঁড়া  শুরু হল৷ সবার মাঝে চাপা গুঞ্জন৷ সাগর তার পুলিশ ড্রেস পরা৷ সে মোটা মোটি অফিসিয়াল ভাবেই অনুমতি ম্যানেজ করেছে৷ যদিও অনুমতি পাওয়াটা বেশ কষ্ট সাধ্য কিন্তু সে ম্যানেজ করেছে৷ 

কবর টা খোঁড়া হচ্ছে৷ আস্তে আস্তে সাবল গুলো মাটির গভীরে যাচ্ছে৷ এক সময় সাদা কাফনের কাপড়ের এক কোনা বেরিয়ে আসতে দেখা গেল৷ আশে পাশে জড় হওয়া মানুষের মাঝে একটা গুঞ্জন দেখা গেল৷ আরো খোঁড়া হল এবার পুরো কাপড় টা বেরিয়ে এল কিন্তু  কোনো লাশ  পাওয়া গেল না৷ এমন কি যদি ধরেও নেয়া হয় শরীরে পচে গেছে কীট পতঙ্গ খেয়ে নিয়েছে  কিন্তু হাড় গোড় তো সেই কাপড়ের ভেতর থাকবে ? কিচ্ছু নেই৷ 

সবার মাঝে একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ করল অকিল৷ সাগর কে ও বল্ল  

এখানকার লোক জন কে এদিকে নিয়ে আয় আমার কথা আছে৷ 

‘স্যার স্যার, কি কান্ড বলেন দেখি এত বছর কাজ করি এই কবরস্থানে এমন জীবনেও শুনি নি’

‘শুনেন নি নাকি লাশ বেঁচে দিয়েছেন’

‘আসতাগফিরুল্লাহ স্যার৷ আমার আল্লাহ্‌ এর ভয় আছে আমর নিজেকে ও একদিন মরতে হবে৷ এই কবরস্থানে আমার দাফন হবে৷ এটাই আমার বাড়ি এটাই আমার ঘড়৷ আমি এই কাজ আজ করলে আমার সাথেও হবে৷’

কথা গুলো বলে লোকটা কন্নায় ভেঙ্গে পড়ল৷ 

‘যেদিন রাতে কবর দেয়া হল সেদিন আপনি ছিলেন এখানে?’ জিজ্ঞেস করল সাগর 

‘স্যার আমি ঈদের দিনেও এখানেই থাকি আমার ঘরবাড়ি নাই পরিবার নাই’

‘কোনো কিছু হয়েছিল কবর টায়? বলতে পারেন কিছু’

‘স্যার তখন তেমন কিছু মনে হয় নাই কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপার টা গুরুতর৷ উনাকে কবর টা দেয়া হয় ভোর চার টার দিকে৷ আমি যখন সকালে এলাম কবর টা ঠিক ঠাক দেয়া হয়েছে কিনা দেখলাম মাটি ঠিক মত চাপা দেয়া হয় নাই৷ এবড়ো থেবড়ো হয়ে আছে৷ উঁচা নিচা৷ আমি আবার যারা কবর এ কাজ করেছিল তাদের ডেকে এনে বকে ঠিক করিয়েছি৷’

‘যারা কাজ করেছিল আছে কেউ?’

‘জী জী’

দুজন লোক কে ধরে নিয়ে আসা হল৷ তাদের কথা মত জানা গেল তার প্রথম বার ই ঠিক মতই দিয়েছিল৷ এতে তাদের কোনো সন্দেহ নেই৷ তবে সেদিন রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল, সেজন্যে হয়তো এটা হতে পার৷ এদিকে কবর টা আবার হাওরের পাশে এদিকে প্রায় ই জমি ধ্বসে পড়ে৷ বেশ কিছু কবর সহ মাটি ভেঙ্গে নিয়ে গেছে স্রোতে৷  অকিল মনে মনে ভাবল৷ ব্যাপাটা ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে৷ লাশ টা একে পাওয়া যায় নি৷ পাওয়া গেলে সব সমস্যার একটা উত্তর এতো৷ এখন আবার জানা যাচ্ছে কেউ হয়তো কবর দেয়ার পর তা কেউ খুঁড়েছে অথবা ন্যাচারাল কারণেও ডিস্টার্ব হতে পারে৷ 

কাজ গুলো করতে করতে দুপুর হয়ে গেল৷ রীতি কিছু খাবে না৷ কোনো একটি কিছু হচ্ছে সে বুঝতে পেরেছে৷ অকিল তার সাথে কথা বলতে গেল 

‘তুমি সব কিছু বুঝ তাই তোমাকে সত্যি কথা টাই বলছি৷ তোমার মা কে কবরে পাওয়া যায় নি৷’

অকিলের কথা শুনে রীতি একাট হাসি দিল৷ 

‘আপনাকে তো বলেছি মা ঢাকায়৷ মমিনের কাছে৷ বিশ্বাস হলো?’

‘মমিন কোথায় থাকে তুমি আমাকে বলবে?’

‘ঢাকায় থাকে, ভুতের গালে’

‘ভুতের গাল কি কোনো যায়গার নাম?’

‘হু’

‘তুমি যায়গাটা চেন?’

‘বাহ, আমি ছোটো মানুষ না? ছোট মানুষরা কি এগুলো চিনে?’

‘মমিন কে দেখলে তুমি চিনবে?’

কথাটার কোনো উত্তর দিল না রীতি, কেন দিল না বুঝতে পারছে না ও৷ রহস্য করছে কেন মেয়ে টা ?

‘মমিন কি কোনো খারাপ লোক?’

এবার মাথা নেড়ে উত্তর দিল রীতি

‘না’

‘আমরা তাহলে বিকেলেই ঢাকা রওনা দেই কি বল ? মা কে খুঁজে বের করতে হবে তো না?’

মেয়েটার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল৷ কিন্তু কি যেন আরো বলতে চায় মেয়েটার চোখ দেখে তাই মনে হচ্ছে৷ 

‘আরো কিছু বলবে৷’

‘মমিনের বাড়ি টা অনেক বড়, অনেক৷’

‘বাড়ি টা তুমি দেখেছ?’

‘হু’

‘দেখতে কেমন আমাকে বলবে’

‘সাদা বাড়ি, অনেক বড় অনেক

‘পাশ দিয়ে বড় নাকি লম্বা?’

‘পাশ দিয়ে’

‘কয় তালা বাড়ি মা বলতে পার?’

‘মনে করতে পারছি না’

‘আশে পাশে কি আছে বলতে পার?’

‘একটা পুকুর আছে, একটা দোলনা আছে, মা দোলনায় বসে আমার কথা ভাবে৷’

‘আর কিছু বলতে পারবে ?’

‘না, আমার অসুস্থ লাগছে আপনি যান৷ আমার খুব ক্লান্ত লাগছে’

ঢাকায় আরেকটা ফোন দিল সাগর৷ বিকাল চার টার দিকে ওরা ঢাকায় রওনা দিল৷

দশ

ঢাকায় এসেছে ওরা প্রায় ১ দিন৷ অকিল দিনে রাতে একটা সাদা বাড়ি খুঁজছে৷ রমনা থানায় যেয়ে অসির সাথে কথা বলেছে৷ সব ঘটনা খুলে বলতে অসি বল্ল 

‘আমি আমার জীবনে এত অদ্ভুত ঘটনা শুনি নি৷ নিশ্চয় এই মেয়ের সাথে কোনো ভাল জীন আছে৷ জীন টা মেয়েটাকে সাহায্য করছে৷ কথাটা বলে একটা অট্ট হাসি দিলেন অসি৷ পরে অবশ্য সাথে সাথে থামিয়ে দিলেন৷ তবে আসার পথে তিনি কথা দিলেন তার সাধ্য মত চেষ্টা করবেন৷ অদিকে চা ওয়ালা সাদেক কে ও খুঁজে পাওয়া গেল না তার আগের যায়গায়৷ সাদেক কে দরকার ছিল অকিলের৷ আবার ঢাকায় আসলে দেখা করে যাবে আর কিছু টাকা দিবে ওর মেয়েটার পড়ালেখার জন্যে কথা দিয়েছিল অকিল৷ 

সেদিন সন্ধ্যার কথা হঠাৎ হোটেলের দরজা নক করছে কেউ৷ সারাদিন পরিশ্রমের পড় স্নান করার জন্যে শুধু রেডি হচ্ছিল অকিল দরজা খুরে দেখল পুলিশের একজন কষ্টেবল দাড়িয়ে আছে৷

‘স্যার, স্যার আপনাকে এখুনি থানায় যেতে বলেছে’

‘স্নান টাই যে করি নাই মশাই, একটু বসুন? আমি স্নান টা করে আসি?’

‘স্যার দ্রুত করবেন দয়া করে আমাদের জরুরী একটা কাজ আছে৷ বুঝেন ই তো দেশের পরিস্থিতি ভাল না৷’

দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আসলেই ভাল না৷ অকিল দেরি করবে না কথা দিল৷ থানায় পৌছুতে পৌছুতে প্রায় রাত সাড়ে সাত টা বেজে গেল৷

‘অকিল সাহেব আসুন আসুন, সাগর সাহেব বসেন৷ গুড নিউজ আপনার ঐ বাড়িটা পেয়েছি মনে হয়৷’

‘বলেন কি!’ উত্তেজিত হয়ে উঠল সাগর 

‘জী, সেটা এক মজার ঘটনা জানেন৷ আমি বিকালে হাতিরপুল গিয়েছিলাম আমার বাড়ির জন্যে কিছু স্যানিটারি জিনিস কিনব বলে৷ আমার বাসা আবার সোবহানবাগ বুঝলেন৷ আপনি তো ঢাকা অত ভাল চিনেন না যাক গিয়ে৷ তো হল কি৷ আমি যাওয়ার পথে দেখলাম সেন্ট্রাল রোডো অনেক জ্যাম৷ তো কি করার ড্রাইভার কে বল্লাম কি করা যায় বল তো, সে বল্ল স্যর ভূতের গলি দিয়ে মেরে দিব নাকি? রাস্তাটা খারাপ কিন্তু চলে যাওয়া যাবে ঠেলিয়ে ধাক্কিয়ে৷ আমি রাজি হলাম হঠাৎ মাথায় খেলে গেল ভূতের গলি৷ আপনি ভূতের গালে ব্যাপার টা বুঝলেন না তো ? ওটা ভূতের গলি , ভূতের গলি৷ আমাদের ঢাকায় একটা যায়গা আছে এই নামে৷ মেয়েটা ছোট মানুষ হয়তো বুঝেছে ভূতের গাল’ 

‘মাই গড’ বলে ফিস ফিস করল অকিল৷

‘আর সেই বাড়ি টা পাওয়া গেল ওটা?’

‘আরে হ্যাঁ সেই পুকুর, ভূতের গলির পুকুর কে না চিনে৷ অপয়া একটা পুকুর৷ প্রতি বছর দুই তিনটা বাচ্চা নিয়ে যায় ঐ পুকুর৷ ওখানে গিয়ে দেখি দিব্বি দাড়িয়ে আছে সেই এক তলা সাদা বিশাল রাজকীয় বাড়ি৷ সে কি এলাহি কান্ড৷ এর বিদেশি ব্যবসায়ীর বাড়ি ঐ বাড়ি জানেন? বাড়ি তো নয় যেন রাজ প্রাসাদ৷ রিশিতার কথা জিজ্ঞেস করতে বল্ল আপনাকে নিয়ে যেতে৷ না হলে এই নিয়ে কোনো কথা বলবে না৷ আমি বাড়ি সার্চ করতে চাইলাম বলে সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে আসতে৷ এখন বুঝতেই পারছেন৷ এসব কারণে ওয়ারেন্ট নেয়া ঝামেলা৷ তাও বিদেশি মানুষ কোন আমলা, কোন মন্ত্রীর সাথে খাতির আমি পরে একটা এমবারাসিং অবস্থায়….’ 

‘আমরা বুঝতে পেরেছি অসি সাহেব৷ আপনি অনেক উপকার করেছেন আরেকটু্ উপকার করেন৷ আমরা জাবেদ সাহেব আর উনার মেয়ে টাকে রেখে এসেছি হোটেলে৷ এখন আমরা এদিক দিয়ে যাই আপনি যদি ওদের একটু নিয়ে আসতেন কাউকে দিয়ে সেই বাড়িতে৷ আমার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে আমাদের লাগবে৷’

অসি সাহেব রাজি হলেন৷ কালাম নামে একজন কে ডেকে কি করতে হবে বলে দিলেন আমরা রওনা দিলাম সেই রাজকীয় বাড়িতে৷ 

এগার

এ বাড়ি তো শুধু বাড়ি না৷ যেন এক রাজ প্রাসাদ৷ বাড়ির গেটের  ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল বিশাল বড় দুটো সিংহের মূর্তি৷ দুই পাশে যেন তারা স্বাগত জানাচ্ছে৷ 

‘সিংহ দিয়ে স্বাগত? বাপ রে’ বলে উঠল সাগর

মেইন বাড়িটার আশে পাশে সুন্দর বাগান করা হয়েছে৷ হাসনা হেনার গন্ধে পুরো বাড়িটা মম করছে৷ 

বাড়ির ভেতরে ও রাজকীয়তার ছাপ পাওয়া গেল৷ দেয়াল মেঝে সব মার্বেল দিয়ে খোদাই করা৷ ড্রয়িং রুমে অনেক গুলো ছবি দেখা গেল৷ অকিল মনোযোগ দিয়ে সেই ছবি গুলো দেখছিল এমন সময় ঠুক ঠুক একটা শব্দ প্রতিধ্বনি হতে শোনা গেল৷ বেশ কিছুক্ষণ পর দেখা গেল নাইট গাউন পড়া একজন বৃদ্ধ এসে দাঁড়িয়েছেন তার হাতে একটা লাঠি৷ লোকটা একটা গলা কাশি দিয়ে 

‘মি. অকিল’ কথা বলতে যেয়ে গলা টা ভেঙ্গে আসল বৃদ্ধের৷ দৌড়ে তার জন্যে পানি নিয়ে এল একজন লোক৷ আস্তে আস্তে ধরে বসিয়ে দিল একটা সোফায়৷ 

‘হাউ ডু ইউ ডু’ বলে সবার দিকে তাকাল যেন সবাইকেই কথা টা বল্ল অকিল৷

অকিল সারাসরি পয়েন্ট এ চলে এল 

‘আমরা রিশিতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম৷ আপনি তো তার নানা হন তাই না?’

‘একটা বিশাল হাসি দিল বৃদ্ধ’ ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছে না সাগর৷ হচ্ছে টা কি৷ অকিল এসব কি বলছে রিশিতার নানা? রিশিতা বেচে আছে? মানি কি? হতাশ চোখে অকিলের দিতে তাকাল সাগর৷

‘ইউ আর রাইট মাই বয়, ইউ আর৷ তা রিশিতা এখানে আছে তোমাকে কে বল্ল৷ তোমরা তো তাকে কবর দিয়ে চলে এসেছিলে৷’

‘আপনি কি ডিনাই করছেন রিশিতা এখানে নেই?’

এদিকে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ পাওয়া গেল বাইরে থেকে৷ রীতি আর  জাবেদ সাহেব এসেছেন৷ সাথে  এসেছেন তার দাদা৷ রীতি রুমে ঢুকতেই বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন৷ আস্তে আস্তে রীতির দিকে এগিয়ে গেলেন৷ রীতির কাছে যেতেই বৃদ্ধের লাঠি টা হাত থেকে পরে গেল৷ হাত টা কাঁপছে ওনার৷ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বৃদ্ধ৷ কাঁপা কাঁপা দুটো হাত দিয়ে মেয়েটার গাল দুটো ধরে কি যেন দেখলেন৷ কিছুক্ষণ পর যেন লোকটার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল৷ জড়িয়ে ধরলেন মেয়েটাকে৷ মেয়েটাকে ধরে এনে কোলের উপর নিয়ে বসলেন বৃদ্ধ৷ সোফার উপর বসে থাকা বৃদ্ধ আর রীতি যেন কত দিনের পরিচিত৷ 

‘কি হচ্ছে আমাকে কেউ কিছু বুঝিয়ে বলবেন?’ রীতিমত চিৎকার করে উঠল সাগর

বৃদ্ধ অকিলের দিকে তাকাল৷ যেন অকিল কে বলছে তুমিই বুঝিয়ে দাও৷  একটু হাসলেন বৃদ্ধ৷ অকিল বল্ল

‘ইনি রিশিতার নানা৷ বুঝতেই পারছ রীতি আমাদের মত সাধারণ কোনো মানুষ না৷ রীতির একটা অসুখ আছে৷ মেডিক্যাল ভাষায় অসুখটার নাম “ক্লেইন লেভিন সিন্ড্রোম” পৃথিবীতে হাতে গোনা মাত্র কয়েক জনের কয়েক জন বলতে ৫-৬ জনের ও কম মানুষের এই রোগ আছে৷ আর এর মাঝে ৩ জনই এই বাড়িতে এখন অবস্থান করছে৷ সুতরাং বুঝতেই পারছ কত রেয়ার রোগ এটা৷ রীতির সিমটমের সাথে অলমোস্ট সব গুলো সিমটোম ই এই রোগের সাথে মিলে যায়৷ টানা দীর্ঘ সময় ঘুমানো, অস্বাভাবিক ক্ষুধা, যৌন চাহিদা, অস্বাভাবিক ভাবে রেগে যাওয়া মন ভাল হয়ে যাওয়া, ডিপ্রেশন সব ই মিলে যায়৷ এই রোগের সিমটম সব গুলো৷ ’

‘তার মানে এখানে জীন ভূতের কিছু নেই? তাহলে এই যে রীতি, রীতি যে এসব বলছে, এই বাড়ির বর্ণনা, তোমার আমার ঢাকায় যাওয়ার কথা আমি যে ওর আসল বাবা, ওর মা যে কবরে নেই এগুলো? এগুলো ও কিভাবে জানে? এখন তুমি নিশ্চয় বলবে না এগুলো রোগের কারসাজি?’ চিৎকার করে কথা গুলো বল্ল সাগর 

অকিল খেয়াল করল জাবেদ সাহেবের মুখের চেহারায় কোনো পরিবর্তন নাই৷ 

‘বাবা তুমি এগুলা কি বলতেস? রীতি তোমার মেয়ে মানে?’ বল্লেন জাবেদ সাহেবের বাবা৷ 

‘অকিল আবার শুরু করল৷ রীতির সাতে এই রোগের অন্য পেশেন্ট দের একটা গুরুত্বপূর্ণ তফাত আছে৷ আমি আগে বলে নেই রোগটা সম্পর্কে আমরা এখনো তেমন কিছুই জানি না৷ বুঝতেই তো পারছ মাত্র কিছু মানুষের আছে৷ এটা নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয় নি৷ অনেক কিছুই অজানা৷ তবে আমার যেটা মনে হয় রীতির ব্রেন অস্বাভাবাবিক বেশি গতিতে কাজ করে৷ এই জন্যে ও ক্লান্ত হয়ে যায়, আমাদের সাধারণ মানুষ থেকে অনেক বেশি ডেটা এরা প্রসেস করতে পারে৷ অনেক দ্রুত অনেক বড় ডিসিশন নিতে পারে৷ তাই ওর প্রেডিকশন ক্ষমতা বেশি৷৷ আর এর ফলে ক্লান্ত হলে আমাদের ব্রেন যা করে তা হল তার হোস্ট কে ঘুম পাড়িয়ে দেয়৷ এমন কি আমি খেয়াল করছি৷ রীতি যখন ঘুমায় তখন ও স্বপ্ন দেখে৷ আমার ধারনা ও তোর মা এর সাথে কমিউনিকেট করতে চায়৷ ট্যলিপ্যাথি বলি আমরা এটাকে বিজ্ঞান এর ভাষায়৷ তবে ওর ট্যালিকিনিসিস আছে কিনা আমি এখনো নিশ্চিত নই৷ সেদিন রাতে যখন আমি একটা আর্ত-চিৎকার শুনে বাইরে এলাম এটা আমার মনে হয় রীতি করে নি৷ আমার মনে হয় চিৎকার টা করছিল রীতির মা৷ আমার মনে হয় সে এখনো ঘুমে আছে৷ আপনারা যেটাকে মৃত্যু ভেবেছিলেন সেটা আসলে মৃত্যু নয়৷ অস্বাভাবিক ভাবে হার্ট রেট কমে  যায় এই রোগী গুলো ঘুমিয়ে পড়লে৷ অন্তত রীতি এবং তার মা এর ক্ষেত্রে তাই হয়৷ মনে রাখতে হবে এক একটা রোগ এক এক ভাবে এক এক জনকে প্রভাবিত করে৷ তবে প্রতিটি রোগ এর কিছু কমন ধর্ম থাকে৷ সেই কম ধর্ম গুলোই হচ্ছে দীর্ঘ সময় ঘুম, অস্বাভাবিক ক্ষুধা, যৌন চাহিদা, অস্বাভাবিক ভাবে রেগে যাওয়া মন ভাল হয়ে যাওয়া, ডিপ্রেশন৷  আর এই পরিবার এর ক্ষেত্রে এই সমস্যা গুলো বাদেও আলাদা কিছু লক্ষণ দেখা যায় আর সেগুলোই আমরা রীতির ব্যাপারে দেখছি৷ 

‘কিন্তু, কিন্তু, না না আমার এগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না৷’ চিৎকার করছে সাগর

‘মি. সাগর, পৃথিবী খুবই আজব আর অজানা একটা যায়গা৷ কতটুকু জানি আমরা পৃথিবী কে ? মধ্য যুগে আমরা যাদের ডাইনী বলে পুরিয়ে ফেলতাম এখনকার যুগে এসে দেখা যাচ্ছে তারা ছিল গবেষক, ডাক্তার৷ বিভিন্ন রোগ বালাই নিয়ে তারা কাজ করত৷ এত আগে প্রযুক্তি ছিল না, ল্যাব ছিল না৷ রোগ বালাই এক্সিডেন্টালই ছড়িয়ে পড়ত আর আমরা সাধারণ জনতা ছিলাম অজ্ঞ কুসংস্কার আচ্ছন্ন আমরা একটা কাজই পারতাম৷ যা কিছু পছন্দ হতনা ধ্বংস করে ফেলতাম৷ মানব জাতির ইতিহাসটাই এমন৷ আমরা যা সহ্য করতে পারি না তা ধ্বংস করে ফলি৷’  

হা হা হাআআ’ হাসতে হাসতে কাশতে শুরু করলেন বৃদ্ধ৷ 

অকিল বৃদ্ধ কে জিজ্ঞেস করল  

‘আপনার স্পাই টা কি সাদেক সাহেব অরফে চা ওয়ালা?’ 

কথা টা বলে বৃদ্ধের পাশে  রাজকীয় সোফার  পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়ানো লোকটার দিকে ইঙ্গিত করতেই লোক টা জ্বিহবা বের করে দাতে কামড়ে ধরল৷  

‘বৃদ্ধ এবার হাসলেন৷ জী, আপনার আই কিউ অসম্ভব ভাল মি. অকিল৷ বলতেই হয়৷ ওকেই স্পাই হিসেবে ওই গ্রামে আমি গত ৮ বছর আগে পাঠাই৷ আমি জানতাম আমার নাতনীর সামনে অনেক কঠিন সময় আসবে৷ আপনি হয়তো জানেন এই রোগ গুলো ছোট বেলায় একবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে যেমন এখন রীতির বেলায় হচ্ছে৷ রোগটা চলে যায় কিছু বছর থেকে৷ আবার বয়স বাড়লে এক সময় এই রোগটা ফিরে আসে৷ আবার চলে যায় অবশ্য৷ একটা মানুষের জীবন নষ্ট করে দেয় জানেন এই রোগ গুলো? আমার বাবা মা কে ও পুরিয়ে মারে কলকাতার লোক জন৷ আমরা কোলকাতায় থাকতাম৷ ডাইনী উপাধি দিয়ে পুরিয়ে মারে ওরা৷ আমাকে বাচাতে যেয়ে আমার বাবা মা আর পালাতে পারে নি৷ আমার বাবা এর ও এই রোগ ছিল৷ আবার বাবা এর মা এর এই রোগ ছিল৷ তার, তার বাবা এর ও ছিল৷ তিনি ইউরোপ থেকে এই ভারতবর্ষে এসে পাড়ি জমিয়েছিলেন ব্যবসা করতে৷ পরে চলে যান আর কোনো খোজ পাওয়া যায়নি তার৷ যদিও তিনি কথা দিয়ে গিয়েছিলেন কিছু পয়সা পাতি কামিয়ে আবার ফিরে আসবেন তার ভালবাসার মানুষের কাছে৷ যাক গিয়ে সেই কথা৷ রিশিতা কে দেখতে চাইলে সাদেক আপনাদের ওর ঘড়ে নিয়ে যাবে৷ রিশিতাকে কবর দেয়ার পর সাদেক ই বুদ্ধি করে কব খুড়ে দেখে বেচে আছে কিনা৷ লোকটার বুদ্ধি আছে বলতে হবে৷ ওর পরিবার আমাদের পরিবারের অনেক পুরানো ভৃত্য৷ যুগ যুগ ধরে এদের পরিবার আমাদের সাহায্য করে যাচ্ছে৷ ও কোনো টাকা পয়সা ও নেয় না জানেন? শুধু জীবন টা বাচাতে হবে কয়টা টাকা অনেক কষ্টে গুজে দেই৷  এই যুগে এমন মানুষ পাওয়া খুব রেয়ার৷ 

‘আপনার ছেলে কেন এই অর্থ সম্পদ ছেড়ে ঐ অজ-পাড়া গায়ে চলে গিয়েছিল? আপনি অনেক কনজারভেটিভ বলে?’

‘তা বলতে পারেন, বোঝেন ই তো আমাদের এই রোগ যাদের হয় তাদের খুব সাবধানে চলতে হয়৷ আমি চাইতাম সে বাইরে টাইরে কম যাবে, খুব বুঝে শুনে বন্ধু বান্ধব করবে৷ কিন্তু একবার সে সেই কি এক গ্রাম অষ্টগ্রাম সেখানে যেয়ে এক গ্রামের যুবতির প্রেমে পড়ল৷ তার পর যা হয় আরকি আমার সাথে বনি বনা হল না৷ আমিও রাগ দেখালাম আরো ম্যচিউর হওয়া দরকার ছিল৷ ছেলেটার সাথে সম্পর্ক গেল৷ কিন্তু আমি সব সময় খোজ রেখেছি ছেলেটার৷ আমার আরেক নাতি যে আছে সে আমার খুব ভক্ত৷ ওর সাথে আমি আস্তে আস্তে ভাল সম্পর্ক করে তুলি৷’

‘একটা জিনিস রিশিতার প্রথম সিম্পটম টা দার্জিলিং এর এক্সিডেন্ট এর পড়ই দেখা দেয় না?’

‘হু, কোনো রকম ইনফেকশন এই রোগের রোগীদের জন্য খুব সমস্যা বুঝলেন৷ এই জন্যে আরো প্রটেকটিভ থাকতাম৷ আমাদের অটো ইমিউন সমস্যা আছে৷ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব নাজুক৷ মি. অকিল আপনি স্মার্ট মানুষ আপনি সব নিজেই বুঝবেন৷ অত তারাহুরা কি৷ যান সাগর কে নিয়ে রিশিতার কাছে যান৷ মেয়েটা এই ছোকরা কে খুব ভালবাসে৷ সরি মি. জাবেদ৷ কথা গুলো বলতে বলতে জাবেদ এর কাছে এসে ওর কাঁধে এসে একটা হাত রাখল বুড়ো৷ ’

জাবেদ শুধু মাথা নিচু করে থাকল৷ একটু পর বেরিয়ে গেল৷ রিশিতি ওর বউ হয়তো ছিল কিন্তু এর পর আর থাকা যায় না৷  যে মানুষটা ওকে কোন দিন ভালই বাসতে পারি নি অভিনয় করে গেছে তার জন্যে আর কি৷ এমনকি মেয়েটা ও ওর না৷ চলে গেলেন জাবেদ সাহেব বাবা টা কে ও নিয়ে গেলেন৷ যাওয়ার আগে রীতির দুই গাল দুটো চুমু দিয়ে বলে গেলেন ভাল থেক মা৷

বুড়ো অকিল আর সাগরের দিকে তাকালেন৷ এই প্রথম বুড়ো অকিলের দিকে চোখে চোখ রেখে তাকালেন৷ তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিলেন৷ এই অন্ধকারেও বুড়োর নীল চোখ গুলো পরিষ্কার বোঝা গেল, জ্বল জ্বল করছে চোখ দুটো৷ চোখ গুলো যেন অকিলের নাড়ী নক্ষত্র সব জেনে নিল৷ কেমন একটা অস্বাভাবিক লাগল অকিলের কাছে৷ পেটের ভেতর গুলিয়ে উঠল৷ বুড়ো সাদেকের দিকে তাকাল, সাদেক কে ইশারায় নিয়ে যেত বল্ল রিশিতার কাছে৷  

রিশিতার কাছে ওদেরকে নিয়ে যাচ্ছেন সাদেক সাহেব৷ 

‘স্যার আমি তো চা ভাল বানাই না আপনি তাহলে আমাকে ঐ বাবে আপনার হোটেলে নিয়ে গেলেন কেন?’

‘সাদেক মিয়া আনার চা খেয়ে আমি ভাবছিলাম, এত বাজে চা আমি আমার বাপের জন্মেও খাই নাই৷ রহস্য টা কি? আপনি বললেন দিনে ২০০ টাকা রোজগার করেন তার মানে ২ টাকা করে কাপে প্রায় ৪০০ কাপ চা বেচেন৷ অসম্ভব৷ আপনার তো না খেয়ে মরার কথা এই বাজে চা বানিয়ে কেউ ২০০ টাকা রোজগার করতে পারে না৷ তবে অবশ্য এটা ঠিক আমি আপনার স্যার এর এই গ্র্যান্ড প্লান আর টিকটিকি গিরি এর ব্যাপারে কিছু জানতাম না৷ আমি মানুষটা কিউরিয়াস, যা কিছু তে অসংগতি দেখি তা ঘাটিয়ে দেখি৷ তাই আপনার রহস্য টা কি বুঝতে আমি আপনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ ’

‘সাদেক মিয়া হাসলেন, তা সার তখন আপনি আমাকে নিয়ে কি ভাবেছিলেন?’

‘আমি ভেবেছিলাম আপনি নতুন ব্যবসায় নেমেছেন৷ আমাকে গুল পট্টি মেরেছেন চা বিক্রির এমাউন্ট এর ব্যাপারে, এটা ভেবেছিলাম৷’

কথা বলতে বলতে রিশিতার রুমে পৌঁছে গেল অকিল৷ ভেতরে যেতে বলে বাইরে দাড়িয়ে থাকল সাদেক মিয়া৷ 

রীতি দৌরে মা এর রুমে ঢুকল৷ মা কে দেখে রীতির তেমন কোনো আবেগ দেখা গেল না৷ আস্তে আস্তে মা এর কাছে গিয়ে মা এর কাঁধের পাশে  বিছানায় যেয়ে বসল রীতি৷ মা এর মাথায় একটা হাত রেখে৷ যেন কি দেখল৷ হয়তো বল্ল মা আমি তোমার কাছে চলে এসেছি আর কোনো ভয় নেই৷ রিশিতা একটা বিছানায় শুয়ে আছে৷ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ও৷ কি সুন্দর দেখতে রিশিতা যেন সৃষ্টিকর্তা নিজের হাতে বানিয়েছেন, পরম যত্নে, অসীম মমতায়৷ রিশিতার উপর চাঁদের আলো অল্প এসে পড়ছে৷  

‘A sleeping beauty.’ কথাটা ফিস ফিস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল অকিলের৷  

পরিশিষ্ট

অকিল আর সাগর চলে যাবে গ্রামের বাড়ি৷ কমলাপুর ট্রেন স্টেশনে অনেক মানুষের ভীর৷ ট্রেন টা প্লাটফর্মে এসে লাগতে টাইম লাগছে  কোনো কারনে৷ 

অকিল বল্ল 

‘তোরা ভাল জুটি হোতি রে, তোর উচিত ছিল ফাইট করা’

‘কথাটা শুনে হু হু করে কেঁদে উঠল সাগর৷’

সাগরের কান্না যেন শুনল না অকিল, বলে গেল 

‘দুজন মিলে গভীর রাতে হারিকেন টা জ্বলে উপন্যাস পড়তি৷ আর তোদের সন্তান তোদের পাশে ঘুমাত৷ তোরা মাঝে মধ্যে তোদের বাচ্চার মুখ টা দেখতি, আবার বই পড়ায় মনোযোগ দিতি৷ রিশিতার দ্রুত পড়তো, তোর জন্য ও অপেক্ষা করত কখন তোর ও পাতা টা শেষ হবে৷ ও অভিমানের সুরে বলত আপনি একটু দ্রুত পড়তে পারেন না৷ ধুর কি একটা ক্লাইম্যাক্স এখন আপনার জন্যে আমি অপেক্ষা করি৷ কেন বাবা বলি আপনি নিজে নিজে পড়তে পারেন না? রিশিতা মুখ বানাত৷ রিশিতারকে রাগলে বেশ সুন্দর লাগে তুই ইচ্ছে করে আরেকটু সময় নিয়ে পড়তি৷’

কথা গুলো শুনে আরো হু হু করে বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠল অকিল৷ 

‘দুজনই বই পড়তে ভালবাসিস, বই দিয়েই তোদের পরিচয় টা হয়েছিল৷ কত মধুর একটা ব্যাপার, সাগর শুনছিশ’

সাগর অকিলের দিকে জলে ভেজা চোখে তাকাল৷  অকিল বল্ল

‘ফাইট টা কিন্তু যেকোনো সময় করা যায়৷ দেরি হয়ে গেছে বলতে কিছু নাই জানিস তো?’

সমাপ্ত

জনসন রোড, পুরান ঢাকা

জনসন রোড, পুরান ঢাকা

২০১৩ সালে BBA শেষ করার পর হঠাৎ করে LLB তে ভর্তি হলাম৷ সবাই আমার উপর ক্ষেপা৷ সবাই ধরেই নিল আমার মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ আমাকে দিয়ে জীবনে আর কিছু হবে না৷ অনেকে অনেক রকম কথা বল্ল অনেক রকম আন্দাজ করল৷ কেউ ভাবল আমি  BBA তে খুব খারাপ রেজাল্ট করেছি সুতরাং আমাকে দিয়ে ঐ লাইনে কিছু হবে না তাই আমি আইন বিদ্যা রপ্ত করতে শুরু করেছি৷ যেহেতু আমার পরিবার এবং আত্মিয় স্বজনদের মাঝে ডজন খানেক (আরো বেশী হবে মনে হয়, কিন্তু ডজন খানেক বল্লে ভাল শোনায় তাই ডজন খানেক ই থাক) আইন পেশায় নিয়জিত৷ সবাই ভাবল আমি সেই সুযোগ নিচ্ছি৷  আবার কেউ ভাবল আমি স্রেফ পাগল হয়ে গেছি৷ কেউ ভাবল BBA আর Law ভাল combination সমস্যা কি ? 

একদিন রাতে একটা গল্প লিখতে বসি (একটু লেখা লেখির বদ অভ্যাস আছে কিনা!)৷ লিখতে যেয়ে আবিষ্কার করলাম যে গল্পটা লিখতে চাচ্ছি তা সম্পর্কে আমার জ্ঞান নাই৷ মানে আমি আইন নিয়ে তেমন কিছু জানি না৷ ঐ গল্প টা লেখা আর হল না৷ তো কি আর করা, জ্ঞান না থাকলে জ্ঞান আহরণ করা লাগে,  জ্ঞান আহরণ করার জন্যে আইন বিদ্যা টা রপ্ত করলাম৷ সেই গল্পটা ও লেখা শেষ হল৷ Scroll করে নিচে নামলেই  সেই গল্পটা পাবেন৷ এই গল্পের চরিত্র রিফাত আজিম ভাইকে না জিজ্ঞেস করেই তার নাম টা ব্যবহার করলাম৷ আশা করি সামনে দেখা হলে মাইর টাইর খাব না৷ 

PDF : http://bit.ly/2hTH3A9 

ePub: http://bit.ly/2ie58y9 

Read Online: http://bit.ly/2h8KHES 

  

হাসি মঞ্জিল 

জনসন রোড এর ঘিঞ্জি একটা বাড়ি । হাসি মঞ্জিল৷  পুরান ঢাকার জজ কোর্ট থেকে একটু এগিয়ে হলুদ রং এর একটা ৩ তলা বাড়ি । দেখে মনে হবে রাস্তা থেকে অনেক ভেতরে। কিন্তু ছোট সরু গলিটা দিয়ে ঢুকলে দেখা যাবে সেই গলির ভেতর যেন অন্য এক দুনিয়া৷ টিন-শেড এর কিছু দোকান, টুকটাক করে রাজ্যের ব্যাস্ততায় কাজ চলছে পুরান যুগের সেই টাইপ রাইটার গুলোতে। কত হাসি কান্না, রাগ অভিমান, শোধ প্রতিশোধ এর সাক্ষী এই টাইপ রাইটার গুলো৷ খারাপ-ভাল মানুষের হয়ে কত জাজের কাছে আবেদন করেছে এই টাইপ রাইটার গুলো । এই টাইপ রাইটার এর বোতাম এর চাপে কত ভাল মানুষের ঝুলে গেছে, আর কত কুখ্যাত খুনি ছাড়া পেয়ে গেছে৷ আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে  বেরিয়ে যাওয়া আর ঝুলে যাওয়ার জন্য কেউ এই টাইপ রাইটার গুলোকে দোষ দেয় না। দোষ দেয় না টাইপিস্ট দের ও। এরা হচ্ছে পুতুল। উকিল রা এদের যেভাবে নাচায় এরা সেভাবেই নাচে৷ 

হাসি মঞ্জিল এর নিচ  তলায় এডভোকেট রিফাত আজিম এর চেম্বার৷ গোল গাল চেহারার লোকটার ভুরিটা বেরুনো শুরু করেছে৷ মাথায় এক ঝাঁক চুল মাঝে মধ্যেই কাজের যন্ত্রণার কাড়ন হয় ওগুলো৷ চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা৷ চশমাটির কাঁচ ঝকঝকে৷ রিফাত আজিমকে মানুষ এক নামে চিনে৷ কুখ্যাত সব মানুষদের ছাড়িয়ে দিতে তার জুড়ি নেই৷ অন্তত লোকে তাই বলে৷ খুন করেছেন ? ডাকাতি করেছেন? ধরা পড়লে রিফাত আজিমের কাছে যাবেন৷ মারাত্মক চতুর আর সুযোগ সন্ধানী এর রিফাত আজিমকে এই দুনিয়াতে সম্ভবত একজন ই ভাল বলে জানে, সে হচ্ছে অরিফ৷ আরিফ ও পেশায় উকিল৷ সে সিভিল মামলা করে৷ খুন খারাপি এগুলো তার পছন্দ না৷ সৎ জীবন যাপন করে৷ প্রতিদিন সৃষ্টি কর্তা যদি তার পাপ লিখে থাকে তাহলে সেটা হবে রিফাত আজিমের সঙ্গে থাকার পাপ !  

রিফাত আজিমের চেম্বারে আরেকজন আছে তান নাম চুক্কু, সে মুহুরি৷ রিফাত আজিম যদি ধূর্ত এর শিরোমণি  হয় তাহলে সে হবে এই দুনিয়ায় তার এক মাত্র যোগ্য শিষ্য৷  

আগন্তুক 

কাচ্চি বিরিয়ানির হাড় সহ মাংসের পিস টা চিবাতে চিবাতে আরিফ কে  রিফাত বল্ল 

‘বন্ধু দিন দিন তো মোটাই হয়ে যাচ্ছি৷ এই গত মাসে ও ৮০ কেজি ছিলাম৷ আজকে সকালে ওজন মাপলাম দেখি ৮৪ কেজি৷ সর্বনাশ টা হয়েছে৷ ওজন কমাতে হবে বুঝলি৷’ 

আরিফ  উত্তর দিল 

‘হু’ 

‘খালি হু বল্লে হবে? কিছু তো করতে হবে৷ কিছু একটা প্লান কর৷ এভাবে চল্লে তো মরে যাব৷ এখন ও বিয়েটাই করলাম না ভায়া৷ তুমি তো বিয়ে করে দিব্বি আছ৷’ 

‘হু’ 

‘শালা আমি যা খাই তুই ও তো তাই খাস, আবার বাড়ি যেয়ে ভাবির হাতে ও তো কম খাস না, তুই মোটা হোস না কেন? নাকি বাড়ি গেলে ভাবি খাওয়া বন্ধ করে দেয় !’ 

কথা টা বলে খুব চিন্তিত মনে হল রিফাত কে , সে চুক্কু কে হাঁক ছেড়ে ডাকল 

‘এই চুক্কু, ওই চুক্কু কই তুই হারামজাদা’ 

‘সার সার’ বলতে বলতে চুক্কুর মুখ দেয়ে সিগারেট এর ধোয়া ধুরমুর করে বের হল৷ 

‘শালা সারাদিন বিড়ি ফুঁকিস, তোরে আর রাখা যাবে না৷ তুই তোর রিপ্লেসমেন্ট খোজ৷ তোরে সামনের মাসেই বাদ, বিড়ি ফুকে না এমন একটা খোজ৷’ 

‘আইচ্ছা স্যার’ 

‘আজকে থেকে আরিফ রে প্রতিদিন যাওয়ার সময় ৪ প্যাকেট কাচ্চি দিয়া দিবি, না কাচ্চি না, এক এক দিন এক একটা দিবি, ঐ যে কি জানি হোটেল টা নামটা কি শালা…’ 

‘স্যার রাজ্জাক!’ 

‘আরে হ, রাজ্জাক ওখান থেকে এক এক দিন এক এক পদ নিয়া আবি৷ শালা আরিফ তোর বউ টা এমন কেন? খাইতে দেয় না আর তুই আমারে বলিস ও না৷ ঐ যা৷ ভুল হয়না জানি৷’ 

আরিফ ততক্ষণে খাওয়া শেষ করেছে 

‘কিরে ঐ তোর খাওয়া শেষ, বউরে বকা দিসি দেখে খাবি না নাকি আর মহা জালা তো শালা৷ খাস না যা’ 

বলে আরিফের আধা খাওয়া কাচ্চির প্যাকেট টা নিজের পাতে তুলে নিল রিফাত৷  

‘আরে আপা সারেরা খাচ্ছে তো, এখন ঢুকলে আমার চাকরি টা যাবে৷ সামনের মাসে যাকে চাকরি টা দেব তার টা ও যাবে’ 

‘ভাই আমার রিফাত স্যারের সাথে দেখা করতেই হবে খুব জরুরী’ 

‘আরে আপা ধৈর্য ধরেন, আপনার কেইস টা কি? এত ক্যাচের ম্যাচের লাগাইলেন কেন ? সমস্যা টা কি বলেন আমারে …’ 

‘ভাই খুনের কেইস’ 

‘ও, খুন কে করসে আপনার জামাই?  

নাকি আপনের ভাই ? ‘ 

‘আমি করেছি ভাই’ 

‘ঐতেরি, আপনে করেছেন?’ 

‘না মানে আমি করি নাই, পুলিশ আমারে খুঁজছে তারা আমি করেছি বলে আমাকে ফাঁশিয়ে দিচ্ছে’ 

‘ও হেইডা কন, তয় আপনে যে ভাবে মাইকিং করতেছেন আপনি খুন করেছেন তাতে পুলিশ তো আপনে ফাঁসাইব ই এটাই তাদের কাজ, খুন হলে কাউরে না কাউরে তো দেখাতে হবে যে তারা ধরসে৷ আর আপনে তো সেই….’ 

‘ঐ কার সাখে পিরিত করিস রে?’  

রিফাত খাওয়া শেষ করেছে ৷ করে চুক্কুরে ডাক দিল৷ 

‘স্যার এক মহিলা আইসে, কি নাম বলল অরিন কি কয়, খুনের কেইস৷ পাঠামু?’ 

‘আপয়েন্টমেন্ট নেয় নাই তো, … আইচ্ছা পাঠা’ 

‘আমি তাইলে যাই রে তুই কথা বল’ বলে আরিফ উঠে পড়ছিল৷ 

‘আরে বয় বয়, পুরা নোয়াখাইল্লা হয়া গেলি কবে, হাফ প্লেট তো অন্তত খাওয়ালাম’  

সাক্ষী 

‘আপা বলেন কি সমস্যা, আপনার খেদমতে কি ভাবে আসতে পারি’ বলে একটা ভুবন ভুলানো হাসি দিল রিফাত৷ 

‘ভাই আমি নিরীহ মানুষ, আমার হাসবেন্ড কে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতাম৷ পুলিশ আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে চাচ্ছে৷ বিশ্বাস করেন ভাই আমি কিছু করি নাই৷’ 

‘আরে আপা তা তো বটেই৷ আপনে করলেই কি না করলেই কি, কথা হল কি ভাবে খুন হল আসয় বিষয় বলেন৷’ 

অরিন (নাম টা এখনো জানা যায় নাই) কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল৷ তার পর শুরু করল 

‘আমাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ, গত মাসের ৫ তারিখ আমি বাড়ি যাই, ৯ তারিখ ফিরি৷ এসে আমার হাসবেন্ড কে আমি মৃত অবস্থায় বাসায় পাই৷ মানুষ জন আমার কান্না শুনে এগিয়ে আসে হাসপাতালে নেয়া হয়, কিন্তু ডাক্তার বলে উনি অনেক আগেই মারা গেছে৷’ 

‘মৃত্যুর কাড়ন?’ 

‘ভাই খাবার এ বিষ!’ 

‘ও খাবারে বিষ?’ 

কথাটা বলে আরিফের দিকে তাকাল রিফাত৷ নীরবে দুজনের মাঝে কি যেন বাক্য বিনিয়ম হল৷  

‘চাক্কু ও চুক্কু এদিকে আয়’ 

‘জী স্যার বলেন’ 

‘কুত্তা টি নিয়া আয়’ 

‘আইচ্ছা স্যার’ 

চুক্কু কিছুক্ষণের মাঝেই একটা বিশাল সাইজের কুকুর নিয়ে আসল৷  মহিলাটা লাফ দিয়ে দাড়িয়ে গেল৷ 

আরিফ নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করছে, ভীষণ বিব্রত সে৷ 

‘ম্যাডাম বসেন, ভয় এর কিছু নাই, আমার কুত্তা এটা নাম fear৷  

আপনে বসেন’ 

‘ভাই কুকুর কেন? হচ্ছেটা কি ?’ 

‘সব বুঝবেন, আপনে বসেন’ 

কুকুর টার দিকে চোখ রেখে ভিত সন্ত্রস্ত ভাবে দুরের একটা চেয়ারে বসল অরিন৷ 

বসতেই কুকুর টা অরিন না ফরিনের কাছে গিয়ে চার পাশে একবার ঘুরে দেখল , তার পর জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল৷ ঠিক দু বার৷ ভয়ে অরিন কেঁদে দিল৷ হাউ মাউ করে কান্না শুরু করল৷ চুক্কু হে হে করে হাসতে হাসতে fear কে নিয়ে গেল৷ যাওয়ার আগে রিফাত fear এর ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিল৷ আর বল্ল, সাব্বাস বেটা৷  

‘ম্যাডাম, আমার কাছে চোর বাটপার, খুনি, রেপিষ্ট সব ই আসে৷ আমি কখনো কখনো এদের কেইস নেই কখনো কখনো নেই না৷ আপনার কেইস টা আমি নিব৷ আপনে বাড়ি গেলে কি আপনাকে এরেস্ট করার সম্ভাবনা আছে নাকি?’ 

‘জী ভাই’ 

কাঁদতে কাঁদতে বলল অরিন৷ 

‘তাহলে এক কাজ করেন, আজকে আত্মীয় স্বজন এর বাড়িতে থাকেন৷ বাপ মা , ভাই  বোন না৷ একটু দুরের আত্মীয়৷ বন্ধু বান্ধব হলে ভাল হয়৷ আপনার এলাকার ওসির সাথে আমি  কথা বলে রাখব , কাল ১০ টায় আপনি নিজে থানায় কিয়ে আত্মসমর্পণ করবেন৷ ৩-৪ দিনের মাঝে জামিন পেয়ে যাবেন৷  চিন্তার কিছু নাই৷ তবে এই দেশে মামলা কত দিন লাগে তার তো ঠিক নাই৷ মামলা যদি হয়৷ মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগবে৷ এখন কাজের কথায় আসি৷ যেদিন আপনার হাসবেন্ড খুন হল সেদিন কখন কোথায় ছিলেন বিস্তারিত আমার জানা আই৷ নিন শুরু করুন৷ ঘটনার আগের দিন রাতে থেকে শুরু করুন৷ ‘  

শুরু করল অরিন   

‘ভাই আমি রাত ১১ টার দিকে ঘুমাতে যাই, সকাল ৫ টার দিকে উঠে, নৌকা করে বাস স্ট্যান্ড আসি সেটা প্রায় ৫ ঘন্টার জার্নি, সেখান থেকে ঢাকার বাস নিয়ে রাত আনুমানিক ১০ টায় বাসয় পৌছাই, ঢাকায় ট্রেন থেকে নামি রাত ৮ টায়৷’ 

‘আরে আস্তে আস্তে৷ আপনি দেখি শর্টকাট মারেন৷ আপনি শর্ট কার্ট মারলে কিন্তু আমাদের কেইস ও শর্টকাট হয় যাবে৷ প্রথমে বলেন আপনার গ্রামের বাড়ি কে আছে৷’ 

‘ভাই ২ বছর আগে আমার হাসবেন্ড এর মা মারা গেছে, তার পর থেকে নিকট আত্মীয় কেউ নেই৷ আমাদের বাড়ি টা যে গ্রামে সেটায় আমাদের আত্মীয় বলে কেউ নেই৷ তবে পাড়া প্রতিবেশী তো আছে৷ তাড়া আপনাকে কেউ দেখেছে সেদিন ভোরে বের হয়ে নৌকায় উঠতে৷’  

‘ভাই আমার জানা মতে না, অত সকালে কেউ তো উঠে নি৷ এখন শিতের সকাল আর তখন অন্ধকার ও ছিল কিছু টা৷ সূর্য পুরো উঠে নি৷ তার মাঝে আমি বের হলে বোরখা পরি৷’ 

‘অ আচ্ছা, কেন গিয়েছিলেন গ্রামে?’ 

‘ভাই প্রতি বছর একবার যাই৷ পূর্ব পুরুষ এর ঘর বাড়ি, maintenance তো লাগে৷’ 

‘Maintenance লাগে তো আপনার হাসবেন্ড করে কি ঘাস খায়’ 

‘ভাই আমার হাসবেন্ড এর গ্রামের দিকে তেমন কোনো ইন্টারেস্ট নাই৷ সে আমাকে যেতে বাড়ন করত৷ তার এসবে পয়সা আর সময় খরচ ভাল লাগেনা৷ তাই এই বিষয়টা আমিই দেখা শোনা করতাম৷ এই নিয়ে আমাদের মাঝে একটু দণ্ড ছিল৷ কিন্তু এটা তেমন কিছু না৷ আছে না আপনার যা ভাল লাগে না আপনি করবেন না অন্য কেউ করলে আপনি বাধা ও দিবেন না সাহায্য ও করবেন না? এমন আরকি !’ 

‘সবই তো বুঝলাম, আমি তো বুঝলাম, জাজ কি বুঝবে? আচ্ছা যাক তার পর নৌকাতে ও কি কেউ ছিল না ? মাঝি ? এই বেটা আপনাকে চিনবে ? ‘ 

‘ভাই বোরকা পড়া ছিলাম৷ মনে হয় না৷ তবে আমি ট্রেন এ মাথা খুলে বসে ছিলাম৷ আমার পাশে যে মেয়েটা বসে ছিল, তার সাথে গল্প গুজব ও করেছি৷’ 

‘আরে বাহ, কাজের কাজ করেছেন, তারে পাব কই? কোনো আইডিয়া?’ 

‘ভাই! না ভাই ! তবে এই টুকু জানি তার নাম রাহেলা৷  সে ফেইসবুক গুঁতচ্ছিল তো সেখান থেকে দেখেছি৷ প্রোফাইলে৷ আর ওই মেয়ের চোখে কোনো সমস্য আছে নিশ্চয়ই৷ মেয়েটার চোখে একটা সান গ্লাস পড়া তার চশমার এক চোখ দিয়ে কিছু দেখা যায় না অন্যচোখে সাধারন পাওয়ার এর গ্লাস পড়া ছিল৷ মানে এক চোখ বন্ধ করা ছিল৷ আমি ওই মেয়ের চেহারা ভুলব না৷ ‘ 

‘মানে ঐ মেয়ের চোখে সমস্য আছে? হায়রে এমন ই witness  পেলেন যার চোখে সমস্যা, কপাল, খালি রাহেলা? আর কিছু নাই ? আগে পরে ? প্রোফাইল ছবি টা মনে আছে ? ‘ 

‘জী জী আমি ফেইসবুকে খুঁজলে পাব, মনে হয় পাব! পাব না ভাই ? ‘ 

বিরক্ত হয়ে রিফাত, আরিফ এর দিকে তাকাল৷ আরিফ অণেক্ষন চুপ থাকার পর মুখ খুলল  

‘ম্যাডাম জলদি ফেইসবুকে তারে সার্চ দেন৷ মানুষ প্রোফাইল পিকচার পাল্টে ফেলে অহরহ৷ দেখেন এতদিনে পাল্টে না ফেল্লে যোগাযোগ করেন৷’ 

আরিফ, অরিন কে জিজ্ঞেস করল আপনি বাসায় গেলেন কি করে ? সি এন জি ? 

‘জি ভাই ‘ 

আমার হাসবেন্ড এর গাড়ি নিয়ে আসার কথা ছিল কিন্তু সে তো আসে নি৷  

জামিন 

অরিন থানায় গিয়ে ধরা দিয়েছে আজ ২ সপ্তাহ৷  অনেক রকম চেষ্টা করেও রিফাত তাকে জামিন নিয়ে দিতে পারে নি৷ জজ সাহেব খুবই কড়া, অনেক চেষ্টা করেও তাকে বোঝানো গেল না যে মেয়ে মানুষ পালিয়ে যাবে কই ! জামিন দেন মামলা চলুক, নির্দোষ প্রমাণ না হলে জেলে পুরে দিয়েন৷ জজের এক কথা খুনের মামলা জামিন নাই৷  

ওদিকে যত দিন যাচ্ছে মামলার অবস্থা খারাপ হচ্ছে৷ ট্রেনে অরিন এর সাথে আসা মেয়েটা যে কিনা একমাত্র সাক্ষী হতে পারে তাকে পাওয়া যায় নি৷ যত দিন যাচ্ছে মেয়েটা ভেঙ্গে পড়ছে৷ এক সময় দেখা যাবে এই সব মামলা মোকদ্দমার ঝুট ঝামেলা তে মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে  বলে বসেছে আমি খুন করেছি৷ মানুষের মাথা আজব ভাবে কাজ করে৷ কখন কি করে বলা মুশকিল৷  

এমন করে আরো ৩ সপ্তাহ গেল অরিন ফরিনের নামে চার্য শিট দাখিল হল, জাজ প্রি ট্রায়াল এর দিন ধার্য করলেন ২ মাস পর৷  

খেলা 

মামলা জিনিস টা হচ্ছে খেলা৷ এটা একটা জুয়া খেলা৷ এই জুয়ার বাজি মানুষের জীবন৷ দুটো দল থাকে৷ এক দল আসামী পক্ষ, যাকে রাষ্ট্র পক্ষ দোষী প্রমাণ করতে চায়৷ আরেক পক্ষ হল রাষ্ট্র পক্ষ যে নিপীড়িতের হয়ে কথা বলে৷ এই খেলার মূল লক্ষ যদিও মনে হতে পারে সত্য উৎঘাটন করা, দোষী কে শাস্তি দিয়ে কিন্তু ব্যাপার টা কিন্তু অত সহজ না৷ এখানে যে যত চতুর সেই জয়ী৷ দোষ নির্দোষ এর কোনো দাম নেই৷  

রবিবার, সকাল ১০ টা ২২ মিনিট, মানুষে গিজ গিজ করা আদালত কামরায় দাঁড়াবার ঠাই নেই৷ রিফাত আজিমের কেইস নাম্বার ডাকল  আদালতের কর্মকর্তা৷ রিফাত আজিম আরো ১০ কেজি বেড়ে যাওয়া শরীর টা নিয়ে কষ্টে উঠে সামনে গেল৷  

জজ সাহেব খুব কড়া মানুষ, নাকের ডগার চশমার ফাকা দিয়ে উকি মেরে রিফাত ও সরকার পক্ষের উকিল আসিফ কে জিজ্ঞেস করলেন  

‘আপনারা তৈরি? আসামি কই?’  

আসামি কে দেখিয়ে দিল রিফাত আজিম .৷  

‘ও আপনি? হাত কড়া কেন ? জামিন দেই নাই ?’ 

কথাটা শুনতেই চিক চিক করে উঠল সুযোগ সন্ধানী রিফাত এর চোখ৷ বল্ল  

‘Your honor…’ 

রিফাত কি বলবে যেন বুঝতে পারল জজ সাহেব হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিল  

‘Miss Orin, how do your plea? কি দোষী নাকি নির্দোষ? ‘ 

কিছুক্ষণের জন্য সময় যেন থেমে গেল৷ রুমে চলতে থাকা সব গুঞ্জন কমে গেল, সবার নজর এখন অরিনের দিকে৷ শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে অরিন দাঁত কির মিড় করে বল্ল নির্দোষ৷ 

স্বভাবতই pre-trial এর অরিন নির্দোষ প্রমাণ করা গেল না , তবে অরিন জামিন পেল, আর ৬ মাস পর মামলার দিন ধার্য করা হল৷   

অপ্রত্যাশিত 

‘বন্ধু রিফাত, এই মামলা টা প্রেস্টিজ পাংচার করে দিবে মনে হয় রে৷’ 

‘ভায়া, তোমার যে কিসে প্রেস্টিজ পাংচার হয় বোঝা মুশকিল, সারা দুনিয়ার চোর ডাকাত কে রিপ্রেজেন্ট করে বেড়াও ওটায় কি প্রেস্টিজ বাড়ে?’  

সিঙ্গারা আর চা মুখে দিতে দিতে উত্তর দিল আরিফ৷  

‘ভায়া ওসব দেখিও না বুঝলা, ওসব আমিও দেখাতে পারি৷ আমি ভাবছি মামলা হারলে ইজ্জত থাকবে না৷ আর তুমি কি শুরু করলে৷ আবার হয়েছে নাকি বউ এর সাথে কিছু? আমার উপর দিয়ে দিচ্ছ কেন ভাই ?’ 

কোনো উত্তর দিল না আরিফ৷  

‘বুঝলে, মামলা টা এত সহজ কিন্তু কোনো সাহায্য পাচ্ছি না৷ একটা সাক্ষী নেই কিছু নেই৷ কোনো কাড়ন ছাড়া মেয়েটাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে বুঝলে৷ পুলিশ গাঁ বাঁচাচ্ছে৷ আর ওই হাসবেন্ড বেটা যে খুন হল সে তো একটা বদমাস৷ আমি খোজ নিয়েছি বুঝলে৷ ক্যারেক্টার ভাল না নেশা টেশা মানে মদ টদ খেত৷ জঘন্য লোক৷’ 

‘তুমি জঘন্য বলছ? তাহলে নিশ্চয়ই জঘন্য৷’ 

‘এই আরিফ, দেখ ভায়া বেশি হচ্ছে কিন্তু, হয়েছে টা কি বলবা? না বলতে চাইলে পারলে একটু সাহায্য কর নাইলে চুপ করে শোন৷ ধুর মেজাজ টাই খারাপ করে দিলে… ‘ 

‘আচ্ছা বল কি সাহায্য করতে পারি বল৷’ 

‘সাহায্য বলতে আমি তোমাকে ঘটনার দিনের পুরা টাইম লাইন টা বলি, তুমি দেখ কোনো ফাঁক ফোকর পাও কিনা’ 

‘হু, শুরু কর’ 

‘অরিন ভোর ৫ টায় রওনা দেয় কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকার পথে৷ সে ঢাকায় পৌছুতে তার রাত ৮ টা বেজে যায়৷ বাসায় পৌছুতে প্রায় ১০ টা বাজে৷ কমলাপুর থেকে মিরপুর৷ দূর আছে৷   বাসয় পৌঁছে সে বাড়ির দরজা খোলা পায়৷ মৃত অবস্থায় পায় তার হাসবেন্ড কে৷ তাকে হাসপাতাল এ নেয়া হয় ডাক্তার মৃত বলে৷ ডাক্তার এর মতে ওনার হাসবেন্ড মারা গেছে সন্ধ্যা ৬ টার দিকে৷  এখন যেহেতু সে ট্রেন এ ছিল সে কিছুতেই খুন করতে পারে না৷ এটা আমরা জানি৷ কিন্তু পুলিশ বলছে৷ অরিন আরো আগেই এসেছে৷ খুন করে বলেছে সে আজ এসেছে৷ পুলিশের মতে সে ঘটনার দিন সকালে এসেছে৷ অথবা দুপুরে ও আসতে পারে৷ হয়তো বাসে চলে এসেছে সময় কম লেগেছে৷ অনেক রকম পসিবিলিটি দেখাচ্ছে৷ পুলিশের কাছে সব চেয়ে বড় মটিভ হচ্ছে এদের সংসারে কলহ লেগে ছিল৷ সারা দিন ই ঝগড়া ঝাটি চলত , অরিনের হাসবেন্ড মদ টদ খেত৷ অনেক ঝামেলা ছিল লোকটার মাঝে৷ পুলিশ বলছে অরিন আর না পেরে তার হাসবেন্ড কে হত্যা করেছে৷’ 

‘আচ্ছা ওনার হাসবেন্ড এর সহায় সম্পত্তি কেমন ছিল?’ 

‘কিচ্ছু না, একটা ফ্যাক্টরি আছে ওদের কলম বানায় পেন্সিল বানায় সেটাও অরিন এর নামে৷ অরিনের বাবার ছিল, সেটা তার হাসবেন্ড চালাত ঠিক ই কিন্তু মালিক অরিন৷ আবার অরিন এর বাবা অনেক ধনী ছিল জমি জমা টাকা পয়সা সব অরিনের নামেই৷’ 

‘সুতরাং টাকা পয়সার জন্য অন্তত মারে নি এটা পুলিশ বলতে পারবে না’ 

‘নাহ, নো ওয়ে’ 

‘আচ্ছা তাহলে এখন বল এই অবস্থায় তোমার ডিফেন্স কি?’ 

‘সেটাই তো ভায়া…’ 

কথা টা শেষ হতে দিল না চুক্কু , হুরমুর করে রুমে ঢুকল৷  

‘স্যার, মিস রাহেলা নামে একজন এসেছে!’ 

‘এখন কারো সাথে দেখা হবে না পরে আসতে বল, এপয়েন্ট মেন্ট ছাড়া আসে কেন কান্ড জ্ঞান নাই? যত্তসব যা’ বলে ভীষণ একটা চিৎকার দিল রিফাত৷  

‘স্যার!!’ 

‘ওই তুই যাবি না মাইর খাবি’ 

‘স্যার মিস রাহেলা, সেই রাহেলা, আরে…’ 

‘রাহেলা মানে কি বলতে চাইছিস….’ চিৎকার কলে উঠল আরিফ 

হঠাৎ ই নামটার গুরুত্ব বুঝতে পেরে লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠল রিফাত৷  

‘বলিস কি? নিয়ে আয় জলদি বাইরে দাড়া করিয়ে রেখেছিস কেন হতচ্ছাড়া’ 

পড়নে হলুদ রং এর একটা সালোয়ার কামিজ, রাহেলা একটু খুরিয়ে খুরিয়ে হাটে৷ খুরিয়ে বল্লে ভুল হবে৷ ডান পা টা একটু টেনে টেনে হাটে৷ উঁচু করতে সমস্যা হয় বোধয়৷হাতে একটা কাল রং এর ভেনিটি ব্যাগ৷ দুই হাতে শক্ত করে বুকের কাছে ধরে রাখা৷ আস্তে আস্তে রুমে ঢুকল রাহেলা৷ বল্ল আস্সালামুয়ালাইকুম ভাইসাব….  

ভাল মানুষ 

‘আপা আপনি রাহেলা?’ খুব একসাইটমেনন্ট এর সাথে জিজ্ঞেস করল আরিফ৷  

‘জী-  ভাই আমি রাহেলা৷ ঐ যে মেয়ে টা অরিন সে আমার সাথে এসেছে৷ আমার পাশে বসেই এসেছে৷ আমি পেপারে মেয়েটার ছবি দেখে সাথে সাথেই চিনতে পারি৷ কিন্তু আসলে পুলিশ-আদালত আমার ভীষণ ভয় লাগে ভাই৷ তাই আমি আসি এত দিন দেখা করি নাই৷ কিন্তু এক সময় আমার মনে হল কাজটা কি ঠিক হচ্ছে একটা ভাল মানুষ এভাবে ফেঁসে যাচ্ছে তাই আর পারলাম না৷ আমার হাসবেন্ড, উনিও আমাকে বোঝালেন ঠিক কাজটাই করা উচিত৷ উনি খুব পরহেজগার মানুষ৷  

রাহেলার কথা গুলো শুনে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল রিফাত এর৷  

‘বন্ধু কি হল’ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল রিফাত…  

‘আচ্ছা তাহলে আপনি বলছেন অরিন আপনার সাথে এসেছে? ঠিক ?’  

‘জী ভাই, আমরা আনুমানিক ৮ টার দিকে ট্রেন থেকে নেমেছি’ উত্তর দিল রাহেলা  

আরিফ যোগ করল   

‘ঠিক তাই বলেছে অরিন ও’ 

‘হু তাহলে তো কিছুতেই অরিন খুনি হতে পারে না৷ কাড়ন পোষ্ট মর্টেম এর ডাক্তার নিশ্চিত করে বলেছে খুন টা কোন মতেই সন্ধ্যা ৬ টার আগে করা হয় নি৷ রিপোর্ট তাই বলে’ 

ভীষণ একটা চাপে ছিল রিফাত৷ এমন একটা মিরাকল হয়ে যাবে ভাবতে পারে নি ও৷ দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেল্ল ও৷ এমন মিরাকল ও হয় ? বাপ রে কখনো ভাবতে পারে নি এমন হবে৷ এভাবে রাহেলা ওদের অফিসে এসে নিজেই সশরীরে হাজির হবে৷ অথচ কত ভাবেই না রাহেলার খোজ নিয়েছে ওরা৷ ভাল মানুষের জন্যে হয়তো এভাবেই সাহায্য এসে হাজির হয়৷ নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত গুলোক মাঝে মধ্যেই  ওকে ভাবাতে শুরু করল৷ 

বহুরূপী মানুষ 

আগামীকাল সকালে মামলা শুরু, হাতের কাজ টি শেষ করে নিচ্ছে দুজন ই৷ হঠাৎ দৌরে এসে চুক্কু হুর মুর করে রুমে ঢুকল৷ রিফাত আর আরিফ দু জনই অবাক৷ 

‘স্যার, স্যার’ বলে দুই হাঁটুতে হাত দিয়ে হাঁপাচ্ছে চুক্কু৷ 

‘স্যার স্যার করছিস কেন রে কি হয়েছে আবার কি আকাম করে এসেছিস৷’ 

 ‘স্যার আপনি বলেছিলেন না রাহেলা নিয়ে খোজ খবর নিতে?’ 

‘হু তা তো নিয়েছিস ও দু দিন আগেই তো বল্লি সব ঠিক আছে৷ ঐ দিকে কোনো ঝামেলা নাই’ 

‘ঝামেলা ছিল না স্যার ঝামেরা হয়েছে’ 

‘খুলে বল’ 

‘স্যার আমি দুইটা পোলা লাগায়ে রাখসিলাম রাহেলা এর বাড়ির সামনে৷ ওরা গত কয়দিন ধরে ওনারে ফলো করছিল৷ আজকে সন্ধ্যার দিকে রাহেলা পাবলিক প্রসিকিউটর   এর চেম্বারে গেছে৷‘ 

‘বলিস কি? সর্বনাশ’ 

আরিফ বল্ল ‘এটা সে করতে পারে না , আমাদের অনুমতি ছাড়া আমাদের সাক্ষীর সাথে কথা বলে কি ভাবে ? কম্প্লেইন দিলে ওর উকালতির লাইসেন্স যাবে তো৷’ 

‘তুই এতদিন করেছিস টা কি? সে মামলার আগের রাতে নিশ্চয়ই হুট করে দেখা করে নাই৷ আগেও নিশ্চয়ই গেছে’ বল্ল রিফাত 

‘স্যার বিশ্বাস করেন এই মহিলা আজই প্রথম গেছে৷ আমি প্রসিকিউটর এর চেম্বারে কে আসে যায় তা ও খেয়াল রেখেছি৷ কোর্টেও নজর রেখেছে এই মহিলা আগে দেখা করে নি৷’ 

রাগে রীতিমত কাঁপছে রিফাত৷ কি করবে বুঝতে পারছে না  ও৷  

‘সালার বেটা পাবলিক প্রসিকিউটর ওর চোদ্দটা বাজায় দিব আমি৷ কত্ত বড় সাহস৷ আমার সাক্ষী হাইজ্যাক? আমার সাথে দুষ্টামি৷’ 

‘বন্ধু শান্ত হও, ঘটনাটা কি বোঝার চেষ্টা করা উচিত আগে কেন গেল জানা যাবে কি?’ জিজ্ঞেস করল আরিফ৷  

‘বোকার মত প্রশ্ন করিস না, রাহেলা কে কি এখন ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা যাবে নাকি যে কেন গেল?, মোটেই যাবে না৷ ফোন দিলে আমরা যে জেনে গেছি সেটাও বুঝে যাবে আরো সতর্ক হয়ে যাবে৷’ 

‘বন্ধু এই সাক্ষীরে তো কাঠগড়ায় দাড়া করানো যাবে না৷ একদম সর্বনাশ করে দিবে৷ সাক্ষী কি উত্তর দিবে না জানলে তাকে কখনোই সেই প্রশ্ন করতে নাই৷ এটা হচ্ছে গোল্ডেন রুল৷ আর এই মহিলা তো পুরাই আমাদের বিপক্ষে চলে গেছে৷ ঘাপলাটা লাগল কই রে বুঝতে পারছি না৷’ 

‘এই মামলা এই সাক্ষী ছাড়া তো বন্ধু একদম ই হারা মামলা৷ এমন কি আমারা কাল যে নতুন তথ্য টা পেলাম সেটাও কোনো কাজে লাগবে না৷ উল্টো এখন যদি কোর্টে আমি বলি মিস অরিন কে তার হাসবেন্ড আরেকজন লোক দিয়ে নিয়মিত ব্যাকমেইল করছিল৷ আর যাকে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করাচ্ছিল সেই খুনি হতে পারে৷ খুনের দায় সেই দিকে নিয়েও তো কোনো লাভ হবে না৷ বরংচ ওই প্রসিকিউটর সালা এখন বলবে ব্যাকমেইল করাচ্ছিল জেনে অরিন তার হাসবেন্ড কে খুন করে ফেলেছে৷ আর মিথ্যা সাক্ষী সাজাতে চেয়েছিল কিন্তু পারে নাই৷’ 

‘বন্ধু তাই তো দেখছি৷ কি করবি এখন’ 

‘আরিফ…’ 

‘হু বন্ধু বল’ 

‘তুই এখন বাড়ি যা, চুক্ক, তুই ও যা৷ আমাকে একটু ভাবতে দে৷’ 

রিফাতের মানুষিক অবস্থা এখন করুন৷ দুটো চোখ যেন বের হয়ে আসতে চাইছে৷ মোটা শরীরে ঘামে ভিজে উঠেছে৷ কপালের রগ গুলো যেন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, লাফাচ্ছে ওগুলো৷ আরিফ কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল , চুক্কুর ইশারায় থেমে গেল৷ একটু পর দুজনে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল৷ আরিফ আর চুক্কু রিফাত এর এই রূপ দেখেছে৷ এই রূপ ওদের কাছে খুব পরিচিত৷ অনেকে ভাবে রিফাত এর মানবিকতা, মূল্যবোধ বলতে কিছু নেই৷ সত্যি কি নেই ? না থাকলে কেন এখন এমন কষ্ট পাচ্ছে ও ? একটা  ক্লায়েন্ট জেলে যাক ফাঁশি হোক অনেক উকিল ই রাতে নাক ডেকে ঘুমাত৷ কিন্তু রিফাত ? তাহলে ও এই কেন খারাপ তমকা টা পায় সব সময় ?  এই যে আজ যা হল, কাল যদি কোন মিরাকল বলে অরিন ছাড়া পেয়ে যায় আদালত পাড়ায় গুঞ্জন উঠবে রিফাত এক খুনিকে ছাড়া পাইয়ে দিয়েছে৷ হাসবেন্ড এর খুনিকে এই লোক ছাড়া পাইয়ে দিয়েছে, হারা মামলা জিতে গেছে নিশ্চয়ই কোথাও দুই নাম্বারি করেছে৷ 

ভুল 

৬ঘন্টা আগে …  

প্রচন্ড শীত পড়েছে, ঢাকার রাস্তা ঘাট ইতোমধ্যে ফাঁকা হতে শুরু করেছে৷ অনেক কষ্টে প্রসিকিউটরের চেম্বার টা খুঁজে পেল রাহেলা৷ বিশাল একটা ভুল হয়ে গেছে ভুল টা না শুধরালে একটা নিরীহ মানুষ বিপদে পড়বে৷ প্রসিকিউটর এর চেম্বারে গিয়ে নিজের পরিচয় দিল রাহেলা, বল্ল কথা আছে আসিফ সার এর সাথে 

‘ম্যাডাম দেখেন আমি আইনত আপনার সাথে কথা বলতে পারি না, যদি না স্বেচ্ছায় আপনি আমার সাথে কথা বলেন৷’ 

‘ভাই আমি অত আইন টাইন বুঝি না৷ আমি একটা ভুল করেছি শুধরাতে চাচ্ছি৷’ 

‘বলুন কি সাহায্য করতে পারি, কি ভুল’ 

‘আমি মি. রিফাত কে বলেছি অরিন আমার সাথেই এসেছিল৷ কিন্তু কথা হচ্ছে আমার ভাল করে ভেবে দেখলাম ও ঘোড়াশাল আসা পর্যন্ত আমার পাশে ছিল না৷ আমার পেশের সিট খালি এই ছিল৷ ঘোড়াশাল এ ট্রেন ছাড়ার পর ও আমার কাছে এসে বসে৷ ‘ 

‘তার মানে সে ঘোড়াশাল যেয়ে এই উঠতে পারে ? ঢাকা থেকে ঘোড়াশাল তো বেশি দুরে না৷ সে দুপুরে রান্না সেরে আরামসে ঘোড়াশাল এ যেয়ে উঠে যেতে পারে , ও মাই গড৷’ 

‘জি, মি. রিফাত কেমন মানুষ আমি জানি৷ সবাই অনেক রকম কথা বলে৷যখন মনে পড়ল,  আমি এটা যেয়ে উনাকে বলতে সাহস পাই নি৷ উনি যদি আমাকে হুমকি দেয়৷ কিছু বলে৷ যদি আমাকে আর সাক্ষী হিসেবে না ডাকে৷’ 

‘মিস. রাহেলা আপনাকে ধন্যবাদ আপনি অনেক উপকার করেছেন৷ আপনি যথার্থ ই করেছেন৷ আপনি আরেকটা রিকোয়েস্ট রাখবেন কি ?’ 

‘জী, বলুন’ 

‘আপনি যে আজ এখানে এসেছেন যদি না বলতেন কাউকে ? কাল আপনাকে ডেকে যখন রিফাত সাহেব যা ই প্রশ্ন করুক আপনি সত্য টা বলবেন , পারবেন ? এতে একজন অপরাধী ধরা পড়বে’ 

কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে রাহেলা সম্মতি দিল৷ 

order, order… order in the court house  

সকাল ১১ টা, 

কোর্ট হাউজের ব্যস্ত  বারান্দা দিয়ে রীতি মত দৌড়চ্ছে রিফাত,  

‘ভায়া রিফাত, টাইটা কি ঠিক আছে?’ 

‘ভায়া, তুমি টাই নিয়ে চিন্তা করছ? টাই আজ বাঁচাবে?’ 

‘হাহা, ভায়া have some faith’ 

দুজন তারা হুড়া করে ঢুকল কোর্ট রুম এ, পেছন পেছন এক গাদা ফাইল নিয়ে চুক্কু ও ঢুকল৷ আরেকটা মামলার কাজ চলছে যাক বাচা গেল৷ এখনো ওদের টা ডাকে নি৷  

সকাল ১১.২৫ 

গলাটা একটু কেশে, পডিয়াম এর সামনে গেল পাবলিক প্রসিকিউটর , বেশ কিছুক্ষণ তার কাগজ পত্র গুছিয়ে একটা হাসি দিয়ে শুরু করল… 

‘Your Honor, এই মামলাটা একদম সাদা মাটা৷ একজন হাসবেন্ড তার বৌকে খুন করেছে৷ খুনের কাড়ন তার হাসবেন্ড তাকে ব্ল্যাকমেইল করছিল৷ আমি জানি এখানে মানবিক বিষয় আসে, আবেগ এর বিষয় আসে কিন্তু মনে রাখতে হবে আইন এগুলোর উর্ধে৷ আইন অপরাধের শাস্তি দেয়, নির্দোষ কে খালাস দেয়৷ এই মামলায় আমি ২ জন সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করব৷ যা কোনো সন্দেহের ঊর্ধ্বে প্রমাণ করবে যে মিস অরিন ই এই খুন টি করেছে৷  

প্রথমেই আসি ঘটনার দিন ,  ঘটনার দিন  ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায়, সন্ধ্যা ৬ টায় মি. আতিক তার নিজ বাসায় খুন হন৷ রাত ১০ টার কিতে পুলিশ কে ইনফর্ম করা হয় তারা নিকটস্থ হাসপাতাল থেকে মি. আতিক এর মৃত দেহ উদ্ধার করে৷  

পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট বলে মি. আতিক সন্ধ্যা ৬ টার দিকে মারা গেছেন৷ তার মানে তার কিছু আগে অন্তত ৩০ মিনিট আগে তাকে বিষ খাওয়ানো হয়৷ উল্লেখ্য ঐ বাসায় মি. আতিক আর তার স্ত্রী মিস. অরিন শুধু এই দুজনই থাকতেন৷  

যদিও মিস. অরিন ক্লেইম করেছেন তিনি ঢাকার বাইরে ছিলেন এবং ঐ দিন রাতে উনার কথা মত আনুমানিক ১০ টায় বাসায় এসে মৃত দেহ পান কিন্তু আমি প্রমাণ করব উনি ঢাকাতেই ছিলেন এবং খুন তিনিই করেছেন৷ That’s all your honor.’ 

‘মি. রিফাত আজিম আপনার ওপেনিং ‘ বলে রিফাত আজিম কে পডিয়াম এর সামনে আসতে বল্লেন জজ সাহেব৷  

‘Your Honor, আমাদের  প্রসিকিউটর সাহেব অনেক কথা বলে গেলেন৷ আমি বেশি কথা বলব না৷ একটা কথাই বলব সত্য সত্যই, সত্যকে মিথ্যা করা যায় না৷ একজন নির্দোষ মানুষকে খুনের দায়ে কাঠগড়ায় দাড়া করিয়ে দেয়া এদেশে প্রতিনিয়ত চলছে৷ আপনার কাছে আমার একটাই আবেদন এই মামলাটির সব কিছু বিবেচনা করে আপনার প্রজ্ঞা দিয়ে আপনি বিচার করবেন৷ Thank you, your honor.’ 

রিফাত কথা শেষ করার পর পর ই প্রসিকিউটর তার প্রথম সাক্ষীকে ডাকলেন৷ কোর্ট রুমের বাইরে থেকে সাক্ষী কে ভেতরে নিয়ে আসা হল ৷  

Oath নিয়ে সাক্ষী এসে কাঠ গড়ায় দাঁড়াল৷ প্রসিকিউটর জিজ্ঞেস করল 

‘আপনার নাম ?’ 

‘স্যার, কাশেম আলী স্যার’ 

সাক্ষীর নাম টি টুকে নিলেন জজ সাহেব৷ সাক্ষী যা যা বলবে উনি তাই লিখে রাখবেন৷  

‘আপনার পেশা মি. কাশেম আলী?’ 

‘স্যার, আমি একটা পরিবহন কম্পানিতে কাজ করি সার৷’ 

‘ঠিক কি করেন মি. কাশেম?’ 

‘স্যার বাস ছাড়ার জন্যে লাইনে আসলে আমি কাস্টমদের ব্যাগেজ গুলা নিয়ে বাসে তুলে দেই৷ আবার কোনো বাস আসলে আমি আমি মালামাল বাসের ব্যাগেজ কম্পারটমেন্ট থেকে বের করে দেই৷ তা ছাড়াও যখন যা লাগে করে দেই যেমন, রাতে বাস পরিষ্কার করা, ড্রাইভার দের খাওয়ানো এরকম আরো খুচরা যা কাজ দেয়া হয় করি৷’ 

‘আচ্ছা, ৯ জানুয়ারি তারিখে আপনি কোথায় ছিলেন মি. কাশেম’ 

‘স্যার আমি ৯ তারিখ ডিউটিতেই ছিলাম’  

‘আসামির চেয়ারে বসা এই মহিলাকে কি আপনি আগে কখনো দেখেছেন ?’ 

‘জী স্যার, ৯ তারিখ সকালে উনাকে দেখেছি স্যার৷ উনি কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসা বাস থেকে ভোর আনুমানিক ৫ টায় নামেন৷’ 

কথাটি বলার পর পর ই কোর্ট রুমে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল৷ অরিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল৷  

‘বিশ্বাস করুন রিফাত সাহেব, আমি ওদিন বাসে আসি নি, এই লোক মিথ্যা বলছে৷’ 

অভয় দিল রিফাত, ‘শান্ত হোন, চিন্তা করেন না, এরকম মিথ্যা , উল্টা পাল্টা সাক্ষী দিতেই পারে  কোনো সমস্যা নাই৷’ 

পাবলিক প্রসিকিউটর এবার কাশেম আলী কে জিজ্ঞেস করল  

‘দিনে কত গুলো বাস আসে মি. কাশেম?’  

কাশেম উত্তর দিল ‘স্যার, দিনে তো প্রায় ৩০ টার উপর বাস আসে বিভিন্ন এলাকা থেকে মিলিয়ে৷’ 

‘মি. কাশেম আপনি বলছেন ৩০ টার বেশি বাস আসে আপনাদের বাসের সিট সংখ্যা কত ? ‘ 

‘স্যার প্রায় ৪৫ জন’ 

‘৪৫ গুন ৩০ মোট ১৩৫০ জন মানুষ৷ এত মানুষের মাঝে আপনার মিস. অরিনের কথা মনে থাকল ?’ কথা টা বলে একটা হাসি দিল প্রসিকিউটর যেন খুব চালাক একটা উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছে৷ উত্তর টা দেয়ার পর ই যেন তিনি আহা বলে লাফিয়ে উঠবেন…  

‘স্যার সবাইকে তো মনে থাকে না, কিন্তু উনাকে মনে আছে৷ উনার ব্যাগ টা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ উনার ব্যাগ এর জন্যে আমি প্রায় ৩০ মিনিট খোঁজাখুঁজি করেছি৷ উনার ব্যাগ খুঁজতে যেয়ে আমার আরেক বাসের যাত্রী উঠাতে দেরি হয়ে যাচ্ছিল৷ সুপারভাইজার রাগারাগি করছিল৷ মিস. অরিন যদিও আমার উপ রাগে নি বা তেমন কিছু বলে নি কিন্তু আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম উনি বেশ বিরক্ত, এবং উনার কোনো তাড়া আছে৷’ 

‘Your Honor, আমার এই উইটনেস থেকে আর কিছু জানার নেই৷’ 

‘মি. রিফাত আপনার ক্রস  ‘ বলে রিফাত কে ডাকল জজ সাহেব বল্লেন 

আপনার cross মি. রিফাত৷  

রিফাত, পডিয়াম এর সামনে এসে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল অরিনের দিকে৷ তার পর কঠিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল 

‘আপনার বয়স কত মি. কাশেম’ 

‘স্যার ৩২ হবে এই জুন মাসে৷’ 

‘৩২ হ্যাঁ!’ 

কথাটা বলতে বলতে প্রসিকিউটর সাহেব চিৎকার করে উৎল ‘  objection your honor, স্যার এগুলার মানে কি ? উনার বয়স দিয়ে কি করবে আমার বোধ গম্য না, কোর্টের সময় নষ্ট করার মানে কি?’  

রিফাতের দিকে তাকিয়ে একটু টিটকারির সুরে হেসে জজ সাহেব বল্লেন মি. রিফাত প্রসিকিউসনের কথায় যুক্তি আছে কি বলবেন আপনি ?  

‘স্যার আপনি তো আমাকে চিনেন, আপনি একটু সময় দেন সব পরিষ্কার হয়ে যাবে’ 

‘becareful. objection sustained মি. রিফাত, সরি’ 

‘মি. কাশেম. এখন আপনি আমাকে বলেন, আপনি যে উনাকে identify করলেন, কিভাবে করলেন? কোনো পুলিশ আপনার কাছে এসেছিল?’ 

‘জি স্যার, ইন্সপেক্টর রাশেদ স্যার একদিন খোজ নিতে আসে৷ আমাকে আসামীর ছবি দেখায় আমি বলি উনাকে তো আমি দেখেছি৷ তার পরই আমার জবানবন্দি নেয় উনারা’ 

‘কবে দেখা করতে আসি মি. রাশেদ?’ 

‘স্যার ১১ তারিখে’ 

‘your honor আর কোনো প্রশ্ন নেই আমার৷’ 

‘আপনি জেতে পারেন মি. কাসেম৷’  

প্রসিকিউশন এর পর ইনভেস্টিগেটর কে ডাকলেন  

‘মি. রাশেদ, আপনি তো এই কেইস এর ইনভেস্টিগেশন অফিসার তাই না ?’ 

‘জী’ 

‘আপনি কি বলবেন কেন আপনি মনে করছেন মি. অরিন ই তার হাসবেন্ড কে খুন করছেন?’ 

‘ওয়েল, দেখেন উনি প্রথম থেকেই মিথ্যা বলছেন, উনি আমাদের জানিয়েছেন উনি ঐ দিন ঢাকার বাইরে ছিলেন অথচ আমরা ইনভেস্টিগেশন করে জানতে পারলাম উনি সেদিন সকালেই ঢাকা এসেছেন  তা ও বাস এ , উনি আমাদের বলেছেন উনি এসেছেন ট্রেনে রাতে এসেছেন৷ উনি ওয়াইফ স্বভাবত ধরে নেয়া যায় উনি সেই খাবার রান্না করেছেন৷  উনার পক্ষে বিষ খাওয়ানোটাই সব চেয়ে সহজ৷  বলে রাখি  খাবার থেকে যে বিষ এসেছে সেটা ডক্টর রা আমাদের নিশ্চিত করেছে৷ আমাদের অভিজ্ঞতা বলে মানুষ মিথ্যা বলে কোনো অপরাধ থাকলে৷ উনি যদি অপরাধ না ই করতেন তাহলে এই মিথ্যা বলার প্রয়োজন ছিল না৷ ‘ 

‘কিন্তু ইন্সপেক্টর সাহেব, আপনারা কি আর কোনো প্রমাণ পেয়েছেন ? যে উনিই খুন করেছে?’ 

‘দেখুন আপনি যদি বলেন আমাদের কাছে খাবারে বিষ উনি মিশিয়েছে এমন কোনো eye withness আছে কিনা বা আমরা কোনো অডিও ভিডিও বা এমন কোনো প্রমাণ দিত পারব কিনা, তাহলে সরি,  আমরা এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারব না৷ কিন্তু তার দরকার ও নেই৷ আমরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারি উনি খনের সময় ঢাকায় ছিলেন৷ ওনারা শুধু হাসবেন্ড ওয়াইফ মিলে থাকে কোনো আলাদা কেউ নেই , কোনো কর্মচারী বা কেউ উনি নিজেই রেঁধেছেন এটা পরিষ্কার৷ এমন কি উনি এটা নিয়ে মিথ্যা বলেছেন যে উনি ঢাকা ছিলেন না৷ উনার কোনো অ্যালিবাই নেই এমন কি উনি কোনো টিকিট ও দেখাতে পারছেন না যে উনি ঐদিনের টিকিট কিনেছেন৷’ 

‘your honor, ইন্সপেক্টর সাহেব কে নিয়ে আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই৷’ 

‘your cross Mr. Rifat’ 

জেরা করা শুরু করল রিফাত 

‘সো মি. রাশেদ আপনি ১৫ তারিখ কাশেম কে জারা করেন আমি ঠিক বলছি কি ?’ 

‘জী’ 

‘জী ? মি. কাশেম আমাকে একটু আগে এই রুমের সবার সামনে বল্ল আপনি তার সাথে ১১ তারিখ দেখা করেছেন মি. রাশেদ’ 

‘ওহ , আচ্ছা , আম… সরি ভুল হয়ে গেছে ওটা ১১ তারিখ ই হবে৷’ 

‘really ? আপনি আন্ডার ওথ, একজন মহিলার জীবন মৃত্যু নিয়ে টানা টানি , এই যে দেখছেন ওনাকে (অরিন এর দিকে আঙ্গুল দিয়ে) ইনি আপনার টেষ্টিমনির জন্যে ফাঁশির কাস্টে ঝুলতে পারে আর আপনি বলছেন যে ভুল হয়ে গেছে? এই ইনভেস্টিগেশন এ আপনি আর কি ভুল করছেন মি. রাশেদ?’ 

‘objection your honor,…’ 

‘মি. আসিফ, overruled.‘ 

‘থ্যাংক ইউ your honor, যা বলছিলাম আর কি ভুল করেছেন?’ 

ইন্সপেক্টর জাজ এর দিকে তাকিয়ে একটা ঢোপ গিলে বল্লেন  

‘দেখুন সব ফ্যাক্ট আপনাদের কাছেই আছে৷ এই কেইস এ ইনভেস্টিগেশন করার খুব একটা কিছু নেই৷ মিস . অরিন মিথ্যা বলছে কেন বলছে ? নির্দোষ মানুষ মিথ্যা বলে না৷ যাদের কিছু লুকানোর থাকে তারা মিথ্যা বলে৷’ 

‘তার মানে আপনি আর কাউকে এই খুনের সাক্ষী হিসেবে ধরেন ই নি ?’ 

‘জী না ‘ 

‘that’s all your honor.’ 

রিফাত কথা শেষ করার পর প্রসিকিউটর দাড়িয়ে বল্ল that would be all your honor, prosecution rest .  

‘very well, মি. রিফাত…’ 

রিফাত দাড়িয়ে রাহেলাকে সাক্ষী হিসেবে ডাকল৷ রাহেলাকে ডাকার পর থেকে চুক্কু আর আরিফের মাঝে টেনশন কাজ করতে শুরু করল৷ মামলা মোটামোটা হারা নিশ্চিত যদি না এখন রিফাত কোনো একটা ম্যাজিক দিতে পারে৷ কি ম্যাজিক দিবে? এই মেয়ে কে সাক্ষী হিসেবে ডাকাই ভুল, কত করে বলেছে শুনল না রিফাত৷ টেনশন এ রিফাত এর ও ভেতরে ভেতরে অবস্থা খারা৷ রাহেলা কাঠগড়ায় দাড়িয়ে একটা হাসি দিল, হাসি দেশে রিফাত এর  মাথায় আগুন জ্বলে গেল৷ রিফাত নিজেকে বুঝাল মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে , রিফাত ও একটা ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে শুরু করল 

‘মি. রাহেলা ৯ জানুয়ারি রাত আনুমানিক ৮ টার দিকে আপনি কোথায় ছিলেন?’ 

‘আমি কমলাপুর ট্রেন স্টেশনে ছিলাম’ 

‘মিস রাহেলা আপনি যখন ঢাকায় পৌঁছুলেন আপনি তখন কোন দিকে বসে ছিলেন ? 

‘আমি আইলের পাশের সিটে বসে ছিলাম৷ আইলের ডান দিকে যেদিকে ট্রেন চলে ওদিক মুখ করে তাকালে ডান দিকে৷’ 

‘মিস. অরিন কোথায় বসে ছিল ?’ 

‘সে আমার ডান পাশে বসে ছিল৷’ 

উত্তর টা শোনার পর পরই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেল্ল আরিফ আর  চুক্কু৷ কিন্তু রিফাত জানে যদিও একটা বড় বিপদ গেছে আরো বড় একটা বিপদ এখনো আছে৷রিফাত জানত মিস. রাহেলা বলবে না যে অরিন ট্রেনে ছিলই না৷ এটা বল্লে তার নিজের রিস্ক বেশী৷ রিফাত জানত প্রসিকিউটর আসিফ অত কাঁচা মানুষ না৷ হঠাৎ যদি এখন রাহেলা স্ট্যান্ড এ এসে বলে আমি ওই মেয়ে কে দেখি নি৷ আমি আরেক জনকে দেখে ভুল বুঝেছিলাম৷ তাহলে তা সন্দেহ জনক লাগবে৷ রাহেলা যদি টাকা খেয়ে থাকে তাহলে সে হয় আজ সাক্ষী দিতে উপস্থিত ই হবে না৷ কিন্তু যদি উপস্থিতহয় তাহলে পুরো  গল্পটা উল্টাবে না৷ বরং বলবে অরিন ট্রেনে ছিল কিন্তু কখন উঠেছে বলতে পারব না, হয়তো বলবে আমি তাকে ঢাকার কাছা কাছি কোনো স্টেশনে ট্রেন আসার পর দেখেছি৷  

ধন্যবাদ মিস. রাহেলা৷ 

‘মিস্টার. আসিফ আপনি ক্রস এক্সামিনেশন করতে পারেন’  

প্রসিকিউটর আসিফ মোটেই রেডি ছিল না, তার মাথা ভন ভন করে উঠল৷ আসল কথা টাই বের করা গেল না৷ মনে মনে ও ভাবল সমস্যা নাই আমি নিজেই করব৷ উঠে দাঁড়াল আসিফ, জিজ্ঞেস করল 

‘মিস রাহেলা আপনি ট্রনে তো কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উঠেছেন তাই না ?’ 

‘objection your honor, প্রশ্ন টি ঠিক হয়নি, এই প্রশ্ন উনি করতে পারেন না!’ 

‘really ? your honer?’ বলে রাগে চিৎকার করে উঠলেন৷ 

একটু হেসে রিফাত বল্ল  

‘মি. আসিফ হয়তো ভুলে গেছেন your honor, ক্রস এক্সামিনেশন এ শুধু মাত্র ঐ বিষয় গুলো নিয়েই প্রশ্ন করা যায় যেই বিষয় গুলো ডাইরেক্ট এক্সামিনেশনে করা হয়েছে৷ আপনি যদি রেকর্ড দেখেন your honor, দেখবেন কোথা থেকে উঠেছে এ নিয়ে আমি কোনো প্রশ্ন করিনি !’ 

জজ সাহেব ভ্রু তে একটা দাগ ফেলে তার চশমার ফাঁকা দিয়ে রিফাতের দিকে তাকাল৷ একটু হেসে বল্ল 

‘মি. আসিফ, মি. রিফাত ঠিক বলছেন, আপনি এই বিষয় এ প্রশ্ন করতে পারবেন না৷ ‘ 

হতাশায় দুই হাত ঝুলে পড়ল আসিফ এর, বুকের ভেতর জেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে৷  

‘তবে your honor, মিস. আসিফ যদি চান  তাহলে উনি মিস. রাহেলাকে withness for prosecution করতে পারেন’  

কথাটা বলে একটা মুচকি হাসি দিল রিফাত, দিয়ে আরিফ এর দিকে তাকাল৷ চুক্কু আরিফ কে বল্ল  

‘স্যার করছে টা কি৷ কেইস টা কি উনি হারতে চায় ? withness for prosecution মানে!’  

ওর কথা টা কেড়ে নিল আরিফ 

‘মানে এখন মি. আসিফ কোথা থেকে উঠেছে  জিজ্ঞেস করতে পারবে৷ মানে রিফাত নিজে কষ্ট করে  যা একটু damage control করেছিল তা আর থাকল না৷  কোথা থেকে উঠেছে এই বিষয়ে কথা বলতে দিতে দিচ্ছিল না কিন্তু এখন তো এটা আসিফ জিজ্ঞেস করতে পারবে৷’ 

মিস. আসিফ যেন হাতে চাঁদ পেল,  

অনুমতির জন্য জজ এর দিকে তাকাল জজ অনুমতি দিল৷ 

এক গাল হাসি নিয়ে বল্ল 

‘ধন্যবাদ মি. রিফাত, মিস. রাহেলা, আপনি জানুয়ারির ৯ তারিখ কোথায় ছিলেন ?  

‘স্যার, আমি দুপুর পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ ছিলাম, সেখান থেকে এগারসিন্দুর ট্রেনে রওনা দিয়ে রাতে ঢাকা পৌছাই৷’ 

‘আপনি কখন প্রথম মিস. অরিন কে দেখেন?’ 

‘স্যার, ট্রেনে’ 

‘কিশোরগঞ্জ থেকেই উনি আপনার পাশের সিটে ছিলেন অথবা আপনি তাকে দেখেছেন?’ 

‘না স্যার, আমি তাকে প্রথম দেখি ঘোড়া শাল এর পর৷ ওখান থেকে ট্রেন ছাড়ার পর  মিস. অরিন আমার পাশে এসে বসেন৷’ 

‘ধন্যবাদ মিস. রাহেলা , that would be all your honor. ‘ 

কথা টা মিস্টার আসিফ শেষ করার সাতে সাথে রিফাত দাড়িয়ে বলে উঠল  

‘স্যার  এই  মামলায় যেহেতু  মিস. রাহেলা প্রসিকিউশন এর উইটনেস হয়ে সাক্ষী দিল আমি তাকে ক্রস এক্সামিনেশন করতে চাই !’ 

আদালত পাড়ায় বিশাল একটা গুঞ্জন শুরু হল৷ জজ সাহেব হাতুড়ি বাড়ি দিয়ে বল্লেন order, order please. তার পর বল্লেন  

‘মি. রিফাত you are a piece of work’ 

আত্ম পক্ষ সমর্থন করে চেয়ে রিফাত কিছু একটা বলতে চাইছিল, জজ সাহেব রিফাত কে থামিয়ে বল্ল  

‘করুন প্রশ্ন করুন’ 

প্রসিকিউশন কোনো একটা প্রতিবাদ করতে চাইছিল জজ সাহেব আবার থামিয়ে বল্ল  

‘stop it মি. আসিফ , আইনত উনি allowed.’ 

রিফাত শুরু করল  

‘ মিস রাহেলা আপনি চোখে এটা কি পড়ে আছেন বলবেন কি ?’ 

‘objection your honor, আমি withness কে  উনার চোখ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করি নি’ কথাটা বলে বিশাল একটা হাসি দিল আসিফ৷ ঠিক ওরকম ই একটা হাসি দিয়ে রিফাত বল্ল 

‘your honor, প্রসিকিউটর মিস. অরিন কে কখন দেখেছে তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন৷ যেহেতু এটি তার চোখ দিয়ে দেখতে হয়েছে তার চোখ কতটুকু নির্ভরযোগ্য আমি তা টেস্ট করতেই পারি৷’ 

ঘটনা কি ঘটছে কোর্ট হাউজের এই রুমে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না৷ সবাই যখন puzzle তখন বেশ বিরক্ত সহকারে জজ আসিফ কে বল্লেন, unfortunately মি. আসিফ উনি আবার ও  ঠিক বলেছেন৷ তিনি overruled করে দিলেন objection. হতাশায় দুমড়ে মুষড়ে উঠল আসিফ৷ ও বুঝতে পারছে এ খেলায় ও হেরে যাচ্ছে৷ অত্যন্ত সু কৌশলে রিফাতের দেয়া সব গুলো trap এই ও পা দিয়েছে৷ রাহেলাকে প্রসিকিউশন এর উইটনেস না বানারে মামলা অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত৷ কিন্তু ও এখনো বুঝতে পারছে না রিফাত করতে চাইছে কি ? চোখে সমস্যা আছে এটা প্রমাণ করে তো এই মামলা ও জিততে পারবে না৷  

রিফাত তার প্রশ্ন শুরু করল   

‘ আপনি কি বলবেন এই রকম চশমা আপনি কেন পড়ে আছেন?’ 

‘আমার চোখে ইনফেকশন হয়েছে আমি এক চোখে ভাল দেখি কিন্তু দুই চোখে দেখতে গেলে ঠিক মত দেখি না৷ ঘোলা আর ডাবল দেখি৷’ 

‘ট্রনে ও কি আপনি এটি পড়ে ছিলেন ?’ 

‘বেশিরভাগ সময় ই পড়ে ছিলাম’ 

‘তার মানে আপনার চোখের সমস্যা বেশ জটিল’ 

চুক্কু আরিফ কে বল্ল, স্যার এই মেয়ে কানা প্রমাণ করা গেলে আমাদের লাভ টা কি ? স্যার করতে চাচ্ছে টা কি ?  

আরিফ ঝারি দিয়ে চুক্কু কে চুপ করিয়ে দিল৷ আজ ও শুধুই দর্শক অনবদ্য এ রহস্যের প্যাচ না খোলা পর্যন্ত ও শুধুই দর্শক৷  

‘দেখুন এটা temporary একটা সমস্যা৷ পার্মানেন্ট কিছু না’ কথা টা বলার পরই বোঝা গেল রাহেলার ego তে খুব লেগেছে৷  রিফাত মনে মনে ভাবল এটাই চাইছিলাম৷ সে প্রশ্ন করল  

‘আপনার চোখ যখন এতই ভাল আপনি কি বলতে পারবেন অরিন সেদিক কি পোষাকে ছিল?’ 

‘অবশ্যই , অরিন হলুদ রঙ্গের একটা পায়জামা পড়ে ছিল,আর লাল ওড়না৷ তবে ও তার উপর কাল বোরকা পড়ে ছিল বেশির ভাগ সময়৷ হিজাব ও করা ছিল’ 

‘আপনার স্মৃতি শক্তি তো খুব ভাল দেখা যাচ্ছে মিস রাহেলা, তো ট্রনে তো আপনি একা ছিলেন না, আপনার সামনে কে ছিল সে কি পড়ে ছিল, সে কি পুরুষ না মহিলা ছিল? উত্তর টি দেয়ের আগে ভেবে দিন কাড়ন মিস অরিন বলতে পারবে কে ছিল’ 

যদিও মিস অরিনের কোনো আইডিয়াই নেই কে কি পড়ে বসে ছিল কিন্তু সে এমন চোখ করল দেখে মনে হল সে আসলেই জানে৷ রাহেলা অনেক্ষন কোনো কথা বল্ল না  

 ‘কি পড়ে ছিল তারা?’ 

‘এত কিছু কি মনে রাখা যায়? আমি কি ট্রেইন এর সবাই কে কি পড়েছিল এখন হিসাব দিব?’ 

‘আপনি মিস অরিন কি পরেছিল পাই পাই হিসেব দিয়ে দিলেন অথচ আপনার আশে পাশে আর কে কে পড়ল এমন কি আপনার ঠিক সামনে যে বসল তার টা বলতে পারলেন না? ট্রনে তো একজন আরেকজনের দিকে মুখ করেই বসে৷ আপনি নিশ্চিত আপনার চোখে সমস্যা নাই? আপনি ঠিক ঠাক দেখেছেন? হয়তো অরিন আপনার পাশেই ছিল চোখের সমস্যার কাড়নে খেয়াল ই করেন নাই হতে পারে কি তা ?’ 

‘না মোটেই না’ 

‘আপনার চোখ নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে আপনি আপনার চোখের একটা টেস্ট নিব, your honor  আপনি যদি অনুমতি দেন’ 

জজ সাহেব মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল  

রিফাত পুলিশ ইনসপেক্ট এর কাছে গিয়ে দাড়ার, উনার মাথায় হাত দিয়ে বল্ল উনি কে?  

‘ইন্সপেক্টর রাশেদ, উনি মামলার তদন্ত করেছেন’ 

এবার রিফাত এর সামনে যেয়ে বল্ল উনি  

‘মি. আরিফ, আপনার সহকারী’  

এবার রিফাত কাশেম আলি যে, অরিন কে বাস স্ট্যান্ড এ দেখেছিল তার মাথায় হাত রাখল  

রাহেলা উত্তর দিল  

‘ কাশেম আলী, উনিই অরিনকে বাস স্ট্যান্ড এ ঐ দিন সকালে দেখেছিলেন ‘ 

উত্তর টা শুনে একটা অট্ট হাসি দিল রিফাত, জিজ্ঞেস করল  

‘আপনার চোখ একে বাড়ে ঠিক আছে মি. রাহেলা, কিন্তু আমার প্রশ্ন হল আপনি মি. কাশেম কে চিনেন কিভাবে ? উনি তো মি. আসিফ এর withness, আর উনি যে অরিন কে বাস স্ট্যান্ড এ দেখেছে আপনি তা জানলেন কি করে ? আপনি তো তখন এই রুমের বাইরে ছিলেন’ 

রিফাতের কথা টা শুনে দাড়িয়ে গেল আরিফ আর চুক্কু একজন আরেক জনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল, মিস. রাহেলার গাল নাক আগুনের মত লাল হয়ে গেল৷ মাথা টা ভন ভন করছে৷ ফেঁসে গেছে ও জানে খুব ভাল করেই৷ এই বদমাশ রিফাত এডভোকেট ধরে ফেলেছে৷ মাথা দ্রুত কাজ করছে রাহেলার৷ ওদিকে রিফাত চিৎকার শুরু করল ‘বলুন মিস. রাহেলা জবাব দিন, আদালত জানতে চায় আপনি কি ভাবে জানলেন’ 

আসিফ দাড়িয়ে ছিল সে বসে পড়ল, ভয়ে তার পা কাঁপছে, ওর কাছ থেকে যে এসব রাহেলা জেনেছে এসব যদি এখন বলে দেয় লাইসেন্স টা হারাবে ও৷ সিরিয়াস বিপদে পড়বে পরিবার নিয়ে৷ সৃষ্টিকর্তার নাম ডাকা শুরু করল ও৷ অবস্থা খারাপ দেখে  

‘বিশ্বাস করুন সার আমার দোষ নাই, এই যে সব দোষ এই কাশেম আলির, অরিন এর হাসবেন্ড ওরে দিয়ে ব্ল্যাক মেইলের টাকা উঠাত, যে বিকাশ নাম্বারে অরিন টাকা পাঠাত এটা এই কাশেম আলির নাম্বার আপনারা চেক করে দেখতে পারেন৷ সোনার ডিম এর পুরোটা পেতে চেয়েছিল এই কাশেম আলী৷ প্রতি মাসে সে ফোন দিয়ে টাকা চাইত অরিনের হাসবেন্ড এর হয়ে, ও একদিন ভাবল টাকার বেশির ভাগ তো অরিনের হাসবেন্ড ই নিয়ে যায়৷ তাকে সরিয়ে দিলে তো  প্রতি মাসে টাকা ওই পাবে৷’ 

কথা শুনে কাশেম আরি দৌর দিল একটা, কোর্ট হাউজে হট্টগোল শুরু হল৷  

জজ সাহেব বল্লেন  

‘হচ্ছে কি এসব, will some one explain to me?’  

কথাটার উত্তর জজ সাহেব someone এর কাছ থেকে চাইলেও কড়া চোখে রিফাত এর দিকে তাকাল৷ রিফাত অনেক কষ্টে হাসি ধরে রাখতে পারল না৷ ভুস করে মুখ দিয়ে হাসি বেরিয়ে গেল…  

জজ সাহেব বল্লেন 

‘order, order… order in the court house’ 

ভীষণ বিরক্ত উনি৷  

  

  

সময়

সময়

এই নিন আপনার পানি , কি ব্যাপার বলুন তো, আপনাকে তো চিনতে পারলাম বলে মনে হয় না ৷ বলে ভ্রু টা একটু কুচকে তাকালেন আজির সাহেব ৷ আজির সাহেব বেশ অধৈর্য মানুষ বলা চলে ৷ তার মাঝে বয়স বাড়লে নাকি মানুষের মেজাজ খিট মিটে হয় আরও বেশি ৷ তাই হবে হয়তো ৷ তার সামনে বসা একটা তরুণ বয়সের যুবক ৷ ছেলেটার চোখে চশমা, পড়নে একটা পাঞ্জাবী ৷ এই বয়সে ছেলে পেলেরা তেমন একটা পাঞ্জাবী পড়ে না ৷ পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে – এই যে শুনছেন কি চাই ? বলে মোটা-মোটি একটা ধমক দিল আজির সাহেব ৷ আজির সাহেবের ধমক শুনে কিছুটা থতমত খাবে বলে ভাবলে ও ছেলেটার মাঝে তেমন বলার তেমন কোনও লক্ষণ দেখতে পেল না আজির সাহেব ৷

মহা বিরক্ত হলেন তিনি, শুরু করলেন , দেখ আমি খুবই ব্যস্ত মানুষ তোমার সাথে বাবা ফালতু সময় নষ্ট করার পরিস্থিতি আমার নাই ৷ ১ মাস ও নাই ঈদ এর এই ম্যাগাজিন সেই ম্যাগাজিন সবার এক কথা আমার লেখা তাদের ঈদ সংখ্যায় চাই ৷ আর তুমি…. কথা টা শেষ করতে পারলেন না আজির সাহেব ৷ ছেলেটা বলে উঠলেন ঠাণ্ডা পানি ! ভীষণ চটে উঠলেন আজির সাহেব , উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন দেখ ছেলে তুমি আমার ছেলের বয়সী হবে বেয়াদপী করছ আমার সাথে ? বাসায় ধুকতে দেওয়াই ঠিক হয়নি দেখছি ৷ আজির সাহেব রাগলে কোনও কিছু থাপড়ান , উনার সামনে কোনও টেবিল নেই তাই সোফার হাতল থাপড়াতে থাপড়াতে কথা গুলো বললেন ৷

ছেলেটা বলে উঠল , দেখুন আপনি আমার ভীষণ শ্রদ্ধার পাত্র আপনাকে অপমান করার প্রশ্নই … কথা টা বলতে শেষ করার আগেই আজির সাহেব বলে উঠলেন আরে রাখ তোমার ধানাই পানাই , মতলব টা কি সেটা পরিষ্কার কর !

ছেলেটাকে বেশ স্বাভাবিক ই মনে হল, কোনও ভাব লেশ হীন একটা অভিব্যক্তি, সেটা আজির সাহেব কে আরও খেপিয়ে তুলছে ৷ অবশেষে ছেলেটা বলল আমি আপনার “রস” উপন্যাসটির একজন ভক্ত ৷ আজির সাহেব বলে উঠলেন তো এখন আমি করব টা কি ?
ছেলেটা বলল জি একটু ধৈর্য ধরুন বলছি ৷ আজির সাহেব মনে মনে ভাবলেন বলে কি ব্যাটা ধৈর্য ধরতে ?? ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার ৷
ছেলেটা বলল যেটা বলছিলাম আপনার উপন্যাস টি খুব ভাল লাগছে ৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আপনি যেই পত্রিকায় এ উপন্যাসটি লিখেন সেই উপন্যাস তারা প্রতি সপ্তাহে একবার ছাপায় ৷ আজির সাহেব বললেন হু তাতে দোষের কি আছে ?
ছেলেটি যেন আজির সাহেবের কথায় গুরুত্ব দিল না, সে বলে গেল , যেহেতু তারা মাসে একবার ছাপায় উপন্যাস টি শেষ হতে আরও দুই মাস লাগবে ৷ আপনার কাছে আমার অনুরোধ আপনি আমাকে বাকি উপন্যাস টুকু পড়তে দিন ! আমি এখানে বসেই পড়ে যাব ৷ সেই পত্রিকা কিনতে যত টাকা লাগে আগামী দুই মাস এ , আমি আপনাকে তা ও দিয়ে যাব ৷ আপনি কি আমাকে এই উপকার টুকু করবেন ?

এবার আর পারলেন না আজির সাহেব ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ! তার মাথার ভেতর যেন একটা বিস্ফোরণ হয়েছে ৷ তিনি তবু নিজেকে সংযত করলেন ৷ করে উঠে দাঁড়ালেন বললেন বের হও ৷ এখুনি বের হও আমার বাসা থেকে ৷ ছেলেটা সেই ভাবলেশহীন চেহারাটা নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ৷ তার পর বের হয়ে চলে যাওয়ার সময় লেখক কে বললেন স্যার লেখক দের অনেক শক্তি তারা সৃষ্টি করে, জীবন দেয় কখনো কখনো ধ্বংস করে, কখনো ভালবাসায় কখনো কাঁদায় ৷ একজন মানুষের কাছে এত ক্ষমতা থাকা বোধয় ঠিক না স্যার ৷ ছেলেটা চলে গেল, আজির সাহেব বেশ অপমানিত বোধ করছেন ৷ এত টুকুন পুচকে ছেলে কত বড় কথা ৷

ছেলেটা যখন বাসায় পৌঁছুল তখন সন্ধ্যা হয় হয় করছে ৷ ছেলেটা মা কে বলল মা তোমার কথাই ঠিক ৷ মা এর চোখে জ্বল টল মল করছে ৷ মনে মনে ভাবলেন খোদা তুমি খুব নিষ্ঠুর ৷ খুব বেশি কিছু চাই না তোমার কাছে মাত্র দুটো মাস আর কিচ্ছু চাই না ৷

ভোরের আধার, রাতের আলো

ভোরের আধার, রাতের আলো

রাতের শেষে ভোর হয় এটাই স্বাভাবিক ৷ কিন্তু কোনটা বেশি সুন্দর রাত ? নাকি ভোর ? আস্তে আস্তে সূর্যের আভা ঢাকার রাজ পথে পড়ছে ৷ আলোয় নাকি অনেক কিছু ধরা পড়ে ৷ আলো নাকি অন্যায় অবিচার সব ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয় ৷ এখন তাহলে অমন একটা সময় ই হবে ৷ কাড়ন রাতের যত কুৎসিত, যত গ্লানি  আলোয় আলোকিত হয়ে যাবে ৷ 

রমনা পার্কের সাইট ধরে একটা ফুট পাথ এ বসে আছি ৷  মাথাটা প্রচুর ধরেছে ৷ কোনও একটা মেডিসিন খেয়ে সোজা বিছানায় যাওয়া উচিত ৷ কিন্তু কি এক নেশায় পেয়ে বসেছে ৷ উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না ৷ প্রচন্ড শীত ৷ কুয়াশা বৃষ্টির মত  পড়ছে ৷ কেউ আমার শার্ট ধরলে হয়তো বলবে ঘেমে ভিজে গেছে ৷ শীতে হুডি ছাড়া টিশার্ট  পড়ি না কিন্তু হায় আজ তা ও পড়ি নাই ৷ প্রচন্ড শীতে নির্ঘাত নিউমোনিয়া হবে মনে মনে হচ্ছে ৷ দূরে একটা ল্যাম্প পোষ্ট জ্বলছে ৷ তার নিচে দুটো ছোটো বাচ্চা একটা পাতলা বস্তা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে ৷ একজনের পুরো শরীর ঢাকলে  আরেক জনের শরীর বের হয়ে যাচ্ছে ৷ কখনো হয়তো পা কখনো হয়তো হাত ৷ কিছুক্ষণ পর পর এ পুরো শরীর ঢাকছে তো ওর পাশে টানা পোড়ন হয়ে যাচ্ছে ৷ কিছুক্ষণ পড়ই সূর্য উঠবে ৷ আমার ধরণীর বুকে প্রাণ ফিরে আসবে  এই দুটো বাচ্চা ছেলে হয়তো আরেকটি রাত কোনও মতে কাটিয়ে দেওয়ার সময় গুনছে ৷ 

  

আমি ফুটপাথ এর যে পাশে বসে আছি তার অপর পাশে এক বৃদ্ধ সারা রাত ধরে কাতরাচ্ছে ৷ 

সম্ভবত কোনও অসুখে ভুগছে ৷ ব্যথায় যন্ত্রণায় এই নিশ্চুপ, স্তব্ধ রাতে যেন বোমা ফাটাচ্ছে ৷ আমি দু একবার ভেবেছিলাম দেখে আসব নাকি , কি সমস্যা ! কিন্তু আমাকে আজ কিসে পেয়ে বসেছে আমি জানি না ৷ আমি যেন ট্রাই পড়ে রাখা একটা ক্যামেরা ৷ রাতের আধার কেটে ভোর আসবে সেটা যেমন ক্যামেরায় বন্দি করতে হলে দীর্ঘ সময় ক্যামেরার রিল চলতে হয় আমিও যেন তেমন ৷ কোনও ভাবেই আমার যায়গা থেকে সরে যাওয়া  চলবে না ৷ আজ আমি  দেখতে চাই, পিচ ঢালা পথে কিভাবে ভোর আসে ৷ 

দূর থেকে একটা যান্ত্রিক শব্দ আসছে ৷ সম্ভবত অনেক দূর থেকে ৷ কিছুক্ষণ পড় বুঝতে পারলাম  একটা নয় দুটো ৷ একটা অবশ্যই পুলিশের গাড়ির সাইরেন ৷ কিছুক্ষণ পড়ে তা আবার মিলিয়ে ও গেল ৷ সূর্যের আভা এখন একটু একটু আসতে শুরু করেছে ৷ রমনা পার্কের গাছ গাছালির ফাঁক ফোকর দিয়ে অল্প বিস্তর আলোর আভা আসতে শুরু করেছে ৷  দূর থেকে রমনা পার্কের গার্ডদের বাঁশির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে ৷ পার্কের ভেতর দিয়ে আসার সময় বেশ কয়েক জনকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি  ৷ ঘুমচ্ছিল বললে হয়তো ভুল হবে ৷ আরেকটি রাত পার করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল ৷ অপেক্ষা ছিল সেই কাঙ্ক্ষিত ভোর এর ৷ 

ব্যাপার টা অনেক অদ্ভুত ৷ সবাই ভোর এর অপেক্ষায় ৷ কিন্তু যখন ভোর আসবে তখন কি হবে ? আমরা কিছু যখন পেতে চাই,  পেয়ে গেলে কি করি ? কখনো ভেবে দেখে নি আমি ৷ কিছুক্ষণ ভাবতে চাইলাম পারলাম না ৷ আমার চিন্তায় ব্যধাত ঘটাল কিছু মানুষের উচ্চ স্বর  আর বাঁশির শব্দ ৷ কিছুক্ষণ পড় এক দল পুরুষ মহিলা বেড়িয়ে এল রমনা পার্ক থেকে ৷ দুজন দৌড় ও দিল ৷ বাকি যারা তাড়াও পা চালিয়ে কোন দিকে চলে গেল বোঝা গেল না ৷ গার্ডদের হাসি ঠাট্টার শব্দ পাওয়া গেল ৷ ফিরে যাচ্ছে ওরা ৷ 

সূর্যের আলো আসতে শুরু করেছে পুরো দমে ৷ রাস্তা ঘাট একদম পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ৷ আমি ভাবলাম ব্যাপারটা কি হল ? সূর্য উঠার প্রতিটা মূহুর্ত দেখতে চেয়েছিলাম ৷ কিন্তু সূর্যটা কখন উঠে গেল ? কখন এত আলো ছড়াতে শুরু করল ? নিজের উপর বিরক্ত লাগল ৷ সারা রাত এই শীতে কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত মূহুর্তটা আমার উপভোগ করা হল না ? 

এগুলো যখন ভাবছিলাম  তখন দেখলাম  বাচ্চা দুটোর ঘুম ভেঙ্গেছে ৷ ঘুম ভেঙ্গেছে বললে হয়তো ভুল হবে ৷ ওদের আজ রাতের যুদ্ধে ওরা টিকে গেছে ৷ দুজন মিলে বস্তা টা গুছিয়ে গলা গলি করে চলে যাচ্ছে ৷ রাতে একজন যে আরেক জনের শরীর থেকে বস্তাটা নিয়ে যাচ্ছিল তা বেমালুম ভুলে গেছে ওরা ৷ দুজনের মুখে নিষ্পাপ একটা হাসি ৷ পেছন থেকে কোথা থেকে যেন একটা কুকুর দৌড়ে এল ওদের পেছনে ৷ কুকুর টাকে আয় আয় বলতে বলতে চলে যাচ্ছে ওরা , কিসের সন্ধানে যাচ্ছে কে জানে ৷ রাতের যুদ্ধ শেষে হয়তো এখন দিনের যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব ৷ কুকুর টা ও যেন ওদের কথা বুঝতে পেরেছে ৷ ওদের পেছন পেছন কুকুর টা ও যাচ্ছে ৷ সম্ভবত কুকুর টা ও বুঝতে পেরেছে এই বাচ্চা দুটোর জীবন আর কুকুরটার জীবনের কোথায় যেন অনেক মিল ! 

মাথার ব্যথাটা বাড়ছে ৷ প্রচন্ড বাড়ছে ৷ কোনও কিছু পেয়ে গেলে সেটা পেয়েছি বুঝতেই পাওয়ার আনন্দের সময়টা চলে যায় ৷ ভোর ঠিকই সূর্যের আলো এনে দেয় ৷  তবে আলো কি আর্তনাদ গুলো, দুঃখ- কষ্ট, নোংরা মানুষিকতা গুলো, অন্যায় অবিচার গুলো কে ধুয়ে মুছে দেয়? নাকি আলোর গর্জনে সেগুলো স্রেফ ঢাকা পড়ে যায় ? আমাদের ব্যস্ততা গুলো কি আমাদের অমানুষ করে দিচ্ছে ? আমরা কি আলোয় আলোকিত হয়ে আলো ছড়ানোর ব্যস্ততায় ভুলে যাচ্ছি আলোর শেষে আধার এর কথা ? মানুষ বলে আলোয় নাকি ভাল দেখা যায় ! কিন্তু আমার কেন উল্টো হয় ? আমি কেন আধারে ভাল দেখি ৷ দিনের আলোয় কেন মানুষের কষ্ট গুলো দেখতে পাইনা ?  তবে কি আধার ই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের বর্বরতাকে , আমাদের নিষ্ঠুরতাকে ? নাকি এ সমস্যা শুধু আমার ই ? 

এখন আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে  চার পাশ ৷ আমি আর ভাল দেখতে পাচ্ছি না ৷ মাথার ব্যথায় প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে ৷ সেই বৃদ্ধর কষ্টটা এখন বুঝতে পারছি ৷ বৃদ্ধটা এখন  কোনও শব্দ করছে না ৷ তার নিস্তর দেহটা পড়ে আছে ঢাকার পিচ ঢালা পথ এ ৷  ঢাকার পিচ ঢালা এই ব্যস্ত নগরীতে রাতের আগে কেউ হয়তো খেয়াল ই করবে না এই বৃদ্ধটা কে ৷ হয়তো গন্ধ ছড়ানো শুরু করলে কিছু মানুষ জড় হবে ৷ তার পর কোনও মতে তুলে নিয়ে মাটিতে পুতে ফেলা হবে৷  বাকি দায়িত্বটা প্রকৃতির ৷  আমি তো ক্যামেরা ম্যান ৷ আমার সামনে কেউ মড়ে গেলে আমার কিছু যায় আসে না ৷ আমি ব্যস্ত ছিলাম সূর্যোদয় এর ছবি মনে গেঁথে নেওয়ায় ৷ কে মরল তাতে আমার কি এসে যায় ৷ আমার দায়িত্ব অসাধারণ কিছু মূহুর্ত মনে গেঁথে নেওয়া আর কোনও দায়িত্ব আমার উপর দিও না ৷ 

আমি উঠে দাঁড়ালাম ৷ এবার বাড়ি ফিরতে হবে ৷  দিনের বেলায় আমি দেখতে পাই না ৷ দিনের আলোয় আমি অন্ধ হয়ে যাই ৷ মাথা ব্যথা সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে ৷ কিছু একটা করা দরকার ৷ 

প্রথম প্রকাশিত , ২ জানুয়ারী ২০১৩ 

রাত ১২.০১

রাত ১২.০১

লেখাটি আমার বন্ধু অনিককে উৎসর্গ করলাম, ওর কাছে রাত আমার মতই অদ্ভুত সুন্দর সময় , আবার কখনো হারিয়ে খুজে সেই রাতগুলোকে…. 

রাত ১২.০১ 

এখন 
রাত ১২.০১ আমার ঘুম থেকে উঠার সময়৷ যেমনটি গত কাল ও ছিল৷ গত কাল ১২.১০ 
এর দিকে বারান্দায় যেয়ে বসে ছিলাম৷ একটা গান শুনছিলাম৷ গানটা স্বপ্ন 
নিয়ে৷ গান শুনছিলাম আর মাঝে মাঝে কয়েকটা সাইট রি ফ্রেশ দিচ্ছিলাম৷ মাঝে 
মধ্যে বাইরে ও তাকাচ্ছিলাম৷ ১২.০১ ঢাকা শহরে তেমন রাত না হলেও আবার অনেক 
রাত৷  অল্প কিছু মানুষ যাচ্ছিল মাঝে মধ্যে৷  হঠাৎ দেখলাম একটা ছেলে ! আমার 
মত বয়স ই হবে কি যেন ভাবলাম … ২ মিনিট দৌরে বাইরে নিচে নামলাম৷ ৫ তলা 
থেকে নামতে ৩ মিনিট এর মত লাগে৷ কিন্তু সেই তিন মিনিট এর সিড়ি ১ মিনিট এর ও 
কম এ নামলাম৷ ৩৪ সেকেন্ড ঘড়ি ধরে ৷ বেরিয়েই চিৎকার করে দারোয়ান কে 
বল্লাদ জলদি খুলেন৷ দারোয়ান আর গেট তখন অনেক দুরে দৌরে বেরুলাম আরো ৫ 
সেকেন্ড৷ বেরিয়ে যেদিকেই ছেলেটাকে যেতে দেখেছিলাম৷ সেদিকে তাকিয়ে দেখি 
কেউ নাই৷ সামনে বিশাল রাস্তা পুরো ফাকা৷ ভাবলাম শিল্পকলার গলি দিয়ে গেছে 
হয়তো৷ অথবা জি টিভি এর গলি দিয়ে৷ দৌর…. 

শিল্প কলার গলি দিয়ে 
দৌরে যেয়ে দেখি একটা ছায়া মত ৷ আরো জোরে দৌরালাম৷ আমার দৌরের শব্দ হয়তো 
লোকটা পেয়েছিল সে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল আমাকে৷ আমি দৌর থামিয়ে দিলাম৷ 
হাপাতে হাপাতে আবার উল্টদিকে দৌর ৷ এবার গেলাম জি টিভি এর গলির দিকে ৷ 
গলিতে ঢুকে তিনটা রাস্তা গেছে ৷ একটা খুবই ছোটো৷ ঐ দিকে কেউ যাওয়ার কথা 
না৷ হয় ডানে  না হয় সোজা যেয়ে ডানে গেছে৷ চোখ বন্ধ করে এক দিকে 
দৌরালাম৷ হঠাৎ দেখতে পেলাম … ঐ তো এটাই সেই ছেলে টা না? 

excuse 
me.. বলে ছেলেটাকে ডাকলাম৷  ছেলেটা চা এর দোকান থেকে একটা সিগারেট 
নিচ্ছিল৷ আমার দিকে তাকাল৷ ছেলেটা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল ৷ আমি হাতটা 
বাড়িয়ে দিলাম৷ 

-আমি শেষ প্রান্তর 

ছেলেটা কিছুটা অবাক হয়ে… 

— শান্ত… আপনাকে আমি চিনি? 

ছেলেটার চুল প্রায় চোখ ঢেকেছে৷  মাথা থেকে চুল গুলো সরিয়ে … একটা জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল৷ 

আমি একটু হেসে 

– নাহ! আমার অন্তত তা মনে হয় না৷ 

ছেলেটা একটু হেসে, তখন আমার অবাক হওয়ার পালা৷ 

– আমি বল্লাম চা খেতে এলাম , একটু হেসে… 

— তো শেষ প্রান্তর টা কোথায়? 

আমি একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে… 

– যখন আপনি চাইবেন তখন ই শেষ, 

ছেলেটা কি বুঝল কি জানি…  মাথা টা একটু নেরে যেন বুঝেছে… যেখানে আমি নিজেউ বুঝি নাই কি বল্লাম… 

— শেষ প্রান্তরে কি পৌছানো যায়? যেখানে দিগন্ত জোড়া মিলে যায়, সাগর আর আকাশ মিলে যায়, সবুজ মাঠ আর নীল আকাশ মিশে যায়? 

একটু দার্শনিকের হাসি দিয়ে, 

– যায় , 

— কি ভাবে? যতই এগুবে ততই তো শেষ প্রান্তর দূরে চলে যাবে মরিচিকার মত 

– 
ঐ যে বল্লাম না , যায়! ফার্মগেট এর ওভার ব্রীজ এ দাড়িয়ে থেক দেখবে কত 
একা মনে হবে! আর আকাশের দিকে তাকিয়ে চাদে যাওয়ার কথা ভেব দেখবে ততই দুরে 
মনে হবে৷ 

— তাহলে? কিভাবে? তুমি তো বল্লে যায়… 

আমি একটু হেসে… হাটা শুরু করলাম… 

দোকানি চাৎকার করে… মামা চা খাবেন না… 

– নাহ মামা তুমি খেয়ে নাও… আমি কাল টাকা টা দিয়ে দেব… 

— কি ভাবে যা? তুমি বল্লে না তো, তুমি যে বল্লে যায়! যায় না কি? তাহলে বল্লে কেন? বলে যাও… 

আমি ছেলেটার দিকে তাকি উল্টো হাটতে হাটতে… 

আকাশের দিকে তাকাও… ছেলেটা তাকাল… 

– এবার চোখটা বন্ধ করতো দেখি… 

এখন রাত ১:৩১ 

আমি 
হাটছি, ছেলেটার সাথে কথা বলে ভালই লাগল৷ জি টিভি এর গলি দিয়ে বেরিয়ে 
বাসার দিকে যাচ্ছিলাম কিন্তু কোথায় যেন, অনেক দূরে৷ বাতাসে ভেষে একটা 
কান্না শব্দ পাচ্ছি৷ মনটা যেন কেমন করে উঠল৷ একটা ছোট্ট বাচ্চার কান্নার 
শব্দ৷ বাইরে ভিষণ বাতাস বইছে৷ বৃষ্টি আসবে৷ বৃষ্টির জল মেশানো আর্দ 
বাতাশের সাথে ঐ কান্নাটা যেন আমার যান্ত্রিক হার্ট  এ এক একটা কামান দাগার 
মত৷ 

আমি যোরে যোরে পা চালালাম৷ না! বাসার দিকে না৷ আমি পা 
চালালাম কান্নার শব্দটির দিকে৷ আমার বাড়ি টা পার করে ডানে ঘুরলাম কাকরাইল 
এর দিকে৷ পুরো রাস্তা ফাকা ১২ অনেক রাত না হলেও ১ টা অনেক রাত৷ 

এখন বাজে ১:৪৩ 

কান্নার 
আওয়াজ টা বাড়ছে, শব্দের তিব্রতা যতই বাড়ছে যেন মনে হচ্ছে আমার হার্টে 
গুলি করার  পরিমান ও বাড়ছে৷ এতক্ষন যেন সাধারন রিভলবার এর পরিবর্তে একটা 
এলএমজি চলছে৷  এবার আমি দৌরালাম৷  কারন এন্টি এয়ারক্রাফট চল্লে আর বাচার 
কোনো আসা নাই৷ 

কাকরাইল এর মেইন রাস্তায় এসে পড়লাম, দৌরোচ্ছি, পার 
হলাম মেইন রোড ৷ উইল্স এর ফুটপাথ থেকে কান্নার শব্দটা আসছিল৷ শব্দটা যেন 
হঠাৎ ই থেমে গেল৷ আমার কি খুশি হওয়ার কথা? কান্না থামলে তো আমার খুশিই 
হওয়ার কথা, তাই না? কিন্তু আমি খুশি হলাম না৷ একটু থেমে ভাবলাম এই 
অনুভুতি টা কি? কান্না থামার পর ও আমি কেন শুখি হলাম না৷ যেন অখুশি হলাম৷ 
শিশুটা কাঁদুক এটাই কি আমি চাই? নাহ! কান্না থামাতেই তো এলাম ! তাই না? 
নাকি কেন কাঁদছে সেই আগ্রহ মেটাতে এসেছি? নাকি আমি কান্না টা থামাতে 
পারিনি বলে আমি হতাশ? 

সত্যি মানুষ কত বিচিত্র, ভাল করে বল্লে সত্যি 
আমি কত বিচিত্র! আমি কাছে গেলাম৷ একটা মা তর শিশুটাকে ঘুম পারাচ্ছে৷ ফুট 
পাথ এ বসে ছিল মহিলাটি, আর ছোট্ট ছেলেটা৷ কাছে যেয়ে বসলাম৷ 

-কাঁদছিল কেন খালাম্মা 

মহিলাটা আমি ফুটপাথ এ বসে গেছি দেখে বিশ্বিত৷ আরো বিশ্বিত দেখে আমি উনার সাথে কথা বলছি দেখে৷ 

— তা জাইনা আফনের কাম কি? আফনার মতলব টা কি? যান যান.. বড় লোকের ছাও… মাথা ঠীক নাই? এইহানে কি করেন? বাড়িত যান.. 

– আমি একটু হেসে৷ যাব, কাঁদছিল কেন বাবু টা? আমাকে একটু কোলে নিতে দিবেন? 

আমার 
দিকে অবাক হয়ে তাকাল মহিলাটা, আমি ভেবেছিলাম হয়তো আমকে ধমক দিবে এমন 
কিছু একটা করবে৷ কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার কোলে তুলে দিল 
বাবুটাকে৷ কি সুন্দর বাবুটা৷ বয়স ৮ মাস এর ও কম হবে৷ নিশ্চিন্তে 
ঘুমোচ্ছে৷ 

উচু উচু দালানের ভীরে এই একটা বাবা হিন ছোট্ট 
ছেলেটা বড় হবে? এক বেলা খাবে আর দু বেলা খাবে না? রাস্তায় বড় হবে এই 
ফুটফুটে বাচ্চা টা? ভাবতেই বিষিয়ে উঠল মন৷ মা কে জিজ্ঞেস করলাম না ওর 
বাবা কই৷ বরং জিজ্ঞেস করলাম৷ 

-ঢাকায় কেন? শিকড় ছাড়া কি ঠিক হয়েছে? 

— কি করবু বাবা ঐ খানে তো কিছু খাওনের নাই৷ বাধ্য হয়া ঢাহা আইসি, 

বাচ্চাটাকে মা এর কোলে ফিরিয়ে দিয়ে বল্লাম 

-একটা প্রশ্ন করি? 

— কি ফ্রশ্ন বাবা? আমি মূর্খ শুর্খ মানুষ আমারে কি জিগাইবেন? 

আমি একটু হেসে 

– আপনার ছেলেটাকে বড় হলে কিরকম দেখতে চান? 

একটু হাসল মা, 

— অন্তত আফনের মতন পাগল না৷ আমার ছেলে শিক্ষিত হবে৷ জজ্ঞানী হবে৷ দেশ আলো করবে… হেহে দেইহেন… 

আমি 
ভাবলাম মা আপনি মূর্খ হতে পারেন কিন্তু আমাদের বাবা মা এর থেকে অনেক 
শিক্ষিত৷ আমাদের বাবা মা চায় ছেলে বড় হয়ে চাকুরি করবে৷ আমি মনে মনে ভাবি 
চাকর গিরি করবে৷ পার্থক্য হল বিদেশিদের চাকর গিরি… হাহহাআআআ 

আমাদের বাবা মা ভাবে আমরা শিক্ষিত হচ্ছি৷ যতই সার্টিফিকেট পাচ্ছি ততই শিক্ষিত৷ একটা কবিতা খুব মনে পড়ল৷ 

লাইন গুলো খুব আবছা মনে পড়ছে… 

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল 

উদার হতে ভাই রে, 

কর্মী হবার মন্ত্র আমি 

বায়ুর কাছে পাই রে। 

পাহাড় শিখায় তাহার সমান- 

হই যেন ভাই মৌন-মহান, 

খোলা মাঠের উপদেশে- 

দিল-খোলা হই তাই রে। 

সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয় 

আপন তেজে জ্বলতে, 

……. 

এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়, 

পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায় 

নাহ কবির নাম টা কিছুতেই মনে পড়ছে না৷ মা এর দিকে তাকি বল্লাম৷ মা ! মা এর চোখে পানি৷ 

আমার 
ভাইটাকে ভিটে মাটিতে নিয়ে যান৷ এই বিশাক্ত নগরীতে আর যাই হোক তাকে 
জ্ঞানী আর মহান করতে পারবেন না৷ জ্ঞান? সে তো জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হয় 
বইয়ের পাতা থেকে না৷  মা আমার দিকে তাকিয়েই থাকল৷ পকেটে কিছু টাকা ছিল৷ 
বের করে দিলাম মা কে৷ মা আমাকে বল্ল 

— বাবা ঠীকই বলচ , এই শহর 
বিশাক্ত৷ টাহা লাগব না৷ আমি ভিক্ষুক না৷ অনেক ভিক্ষুক আচে তাদের দেন 
গিয়া৷ আমারে না…  ছেলেটাকে নিয়ে মা হাটা শুরু করল৷ আমি বসে বসে ভাবছি 
মা কোথায় যাবে?  ভিটে মাটিতে? কিভাবে যাবে? উনি যেতে পারবে? এত পথ কিভাবে 
পার করবে? উনার কাছে টাকা পয়সা যে কিছু নেই তা নিশ্চিত! কিভাবে যাবে? 
বুকের মধ্যে একটা ব্যাথা অনুভব করলাম৷ 

হঠাৎ একটু হাসলাম৷  নিজের কথা গুলোই আবার মনে পড়ল 

এই বিশাক্ত নগরীতে আর যাই হোক তাকে জ্ঞানী আর মহান করতে পারবেন না৷ জ্ঞান? সে তো জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হয় বইয়ের পাতা থেকে না৷” 

অনেক 
জোরে হাসলাম এবার৷ ঐ মহিলাটির চোখ দুটো ভেসে আসল আমার চোখের সামনে৷ একটা 
কথাই নিজের অজান্তে বল্লাম৷ দৃড়তা! দৃড়তা এর ডেফিনেশন কি এটাই? 

জীবন 
থেকে শিক্ষা? সেটা কি ঐ মহিলাটি থেকে কেউ বেশি নিয়েছে? ঐ পথ টুকু উনার 
কাছে কিছুই না৷ সারা জীবন যে স্ট্রাগল করেছে এতটুকু পথ উনার কাছে খুবই 
সামান্য৷ কিন্তু আমার কাছে? আমার কাছে ঐ পথ বিশাল৷ কারন আমি জীবন থেকে 
শিক্ষা নেই নি৷  আমি সব কিছু টাকা দিয়ে কিনি৷ জীবন মানে আমার কাছে বই এর 
পাতা আর শ্রেণী কক্ষে শিক্ষকের লিখে দেওয়া বুলি… হাহাহাআআ 

অনেকক্ষন একা একা হাসলাম৷ 

উঠে বাসার দিকে রওনা দিলাম৷ পৌছুতে কি পারব বাসায়? নাকি আবার অন্য কোনো দিকে কান্নার শব্দ শুনতে পাব? 

রাত ৩.৩২ 

নাহ! বাসায় যাওয়া হলো না … 

কাকরাইল এর মোড় টা পার করতে যেতেই এক দল ছোকরা আমার পথ রোধ করে দাড়াল ৷ 

একজন 
আমার পেছন থেকে হাত দুটো শক্ত করে ধরে ফেল্ল ৷ আমি মনে মনে হাসলাম ৷ 
সালারা কি আমার কাপড় চোপড় খুলে নিবে নাকি ? কারন কয়েকটা টাকা আর এই 
কাপড় চোপড় ছাড়া তো সাথে কিছুই নাই ৷ 

আমার সামনে তিন জন এসে 
দাড়াল, এক জন এর হাতে বিশাল একটা ছুড়ি… ছুড়ি বল্লে ভুল হবে , কোরবানির 
সময় এই টাইপ ছুড়ি দিয়ে গরু জবাই করে ৷ আরেক জনের হাতে একটা ডিজাইন 
ওয়ালা ছুড়ি ৷ এই ছুড়ি টা পরিচিত ৷ নিউমার্কেট এর ২ নাম্বার গেট এ এই 
ছুড়ি গুলো পাওয়া যায়৷ এক একটা ৬০০ টাকার মত চায় ৷ 

মনে মনে 
ভাবলাম ভাবল ইনভেষ্টমেন্ট তো ভালই ৷ রিটার্ন আজকে খারাপ হবে ৷ যার হাতে 
কিছু নাই মনে হয় সে নেতা ফেতা টাইপ কিছু একটা হবে ৷ সে বল্ল কোনো গেঞ্জাম 
করবি না, করলে …. করলে কি আর বল্ল না ৷ 

আমি কিছুই করলাম না ৷ আমার 
কাছে কিছুই নাই যে নিবে ৷ একজন আমার পকেট এ হাত দিল ২০০ টাকার মত পেল ৷ 
আর কিছুই না ৷ একজনের চোখ যেন জ্বল জ্বল করছে ৷ নেতে ফেতা টাইপ লোক টা 
বল্ল, সালা কিছু নাই , পেছন থেকে একটা গলা বলে উঠল বস ধইরা দেই ? আমি 
কিছুই করছি না ৷ একটু হাসছি ৷ নেতা ফেতা টাই টা আমার গেঞ্জির কলার ধরে 
আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল ৷ দিয়ে বল্ল যা শালা ভাগ, শালা ফকির এর 
বাচ্চা … 

আমি দেখলাম এই কথা বলে আমার দুইশ টাকা পকেটে ভরল ৷ আমি 
মনে মনে ভাবলাম এভাবে অপমান তো সহ্য করা যায় না ৷ একবার ভাবলাম কিছু করার 
প্রয়োজন নাই  শেষে প্রান টাই হারাব ৷  কিন্তু হঠাৎ মাথায় রক্ত উঠে গেল ৷ 
হঠাৎ মনে হলো কিছুতেই কিছু যায় আসে না ৷ হঠাৎ ই যেন সব ভয় উড়ে গেল ৷ 
যেন এ্‌ই জীবনের কোনো প্রয়োজন নাই ৷ জীবনে একটাই লক্ষ আজ হয় ওরা মরবে না 
হয় আমি ৷ 

মানুষের মস্তিষ্ক সত্যি অদ্ভুত, মানুষ নিজেকে এত 
ভাল মটিভেট করতে পারে না উপলব্ধি করলে বোঝানো খুবই মুশকিল ৷ এই মূহুর্তে 
হয়তো একটা জিনিস ছাড়া আপনার জীবন অচল ৷ অথচ পরবর্তি মূহুর্তে সেটার 
হয়তো কোনো প্রয়োজন ই নাই ৷ 

এদের একটু অপমান করি  মনে মনে ভাবলাম, 
আবার ভাবলাম আজকে মেরেই ফেলব সবগুলোকে ৷ ওরা কয়েক কদম এগুলো পেছনে ফিরে 
একজন আবার আমাকে দেখল ৷  আমি উঠে ওদের পেছনে হাটা শুরু করলাম ৷ একজন কি 
যেন ফিস ফাস করে কি বল্ল নেতার কানে কানে ৷ নেতা টাইপ লোকটা আমার দিকে 
তাকাল ৷ তাকিয়ে থামল ৷ আমাকে একটা অশ্রব্য ভাষায় গালি দিয়ে আঙ্গুল তুলে 
বল্ল ভাগতে বল্ল নাইলে নাকি আমাকে রাস্তায় কেটে কয়েক টুকরা করে ফেলে 
যাবে ৷ আমি কথাটা শুনে মনে মনে হাসলাম ৷ এগুতে থাকলাম আমি ৷ চার জন ই এখন 
বিভ্রান্ত ৷ কি করবে বুঝতে পারছেনা যেন ৷ 

কত শক্তিশালি ওরা , 
হাতে অস্ত্র আছে, আমি ভাবলাম তবুও আমাকে ভয় পাচ্ছে ? এতক্ষনে আমার দিকে 
ছুড়ি বাগিয়ে তেড়ে আসার কথা না ? কেন আসছে না ? আমি কিসের নেশায় এগিয়ে 
যাচ্ছি ? আমার মাথায় রক্তের নেশা ছলাক দিয়ে উঠল ৷ আমি পরিষ্কার দেখতে 
পারছি আজ মৃত্যু নিশ্চিত ৷ 

চার জনের সাথে একজন মানুষের পেরে উঠার 
কোনো কারন নাই ৷ তার মাঝে আমি এমন কোনো ব্যক্তি না যে তাদের কুপকাত করে 
বীর দর্পে দাড়িয়ে থাকব ৷ আমি অতি সাধারন মানুষ ৷ ৪ জন কেন ২ জন এর সাথেই 
পারার কথা না ৷ আবার যেখানে ওদের মোটা মোটি সবার কাছেই ছুড়ি চাকু আছে ৷ 

আমি 
অতকিছু ভাবলাম না আসলে, এগুতে থাকলাম , মনে একটা কথাই বার বার ভাসতে লাগল 
রক্ত, রক্তের নেশা আজ আমাকে পেয়ে বসেছে ৷ হঠাৎ মনে হল সব কিছু যেন লাল 
লাল মনে হচ্ছে ৷ 

হঠাৎ একটা শব্দ শুনরাম, শব্দটা পরিষ্কার ভাবে এল না 
আমার কানে ৷ কিন্তু পরক্ষনে দেখলাম চার জোড়া , নাহ পাচ জোড়া পা দৌরোনো 
শুরু করেছে ৷ পালাচ্ছে  ওরা ধরতে হবে ৷ হঠাৎ বুঝলাম আর তাড়া করে লাভ নাই ৷ 
চার জন চার দিকে দৌরে পালিয়েছে ৷ মনে মনে হাসলাম ৷ যেন নিজেকে নতুন করে 
আবিষ্কার করলাম ৷ হাহাহাআআআআআ 

হাসতে হাসতে রাস্তায় বসে পড়লাম ৷ কি 
অদ্ভুত মানুষের চিন্তা ভাবনা ৷ ঐ চার জন এর হাত থেকে নিশ্চিত ধোলাই 
খাওয়া থেকে ধোলাই বল্লে ভুল হবে ৷ নিশ্চিত ছিন্ন ভিন্ন করে  কয়েক টুকরা 
হয়ে যাওয়ার কথা যেখানে সেখানে আজ ওরাই পালিয়েছে ৷ আচ্ছা ওরা পালিয়ে 
গেল কেন ?  আমার মত একটা মানুষকে দেখে পালানোর কি কিছু আছে ? ইচ্ছা করলেই 
মেরে কয়েক টুকরো করে ফেলতে পারতো না আমাকে ? কিন্তু কেন পালাল ? 

যেন 
পরক্ষনেই একটা দৈব শব্দ শুনতে পেলাম, আসলে শব্দ টব্দ কিছু না ৷ আমার 
মস্তিষ্কের ই কারসাজি , শুনতে পেলাম  আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য 
সুন্দর… আর সত্যের চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু কি আছে ? 

রাস্তায় এবার 
শুয়ে পড়লাম ৷ খুবই ক্লান্ত লাগছে ৷ এভাবে দৌরা দৌরি আসলে আমার সাঝে না ৷ 
হার্টে এ সমস্যা ৷ হাতে মাত্র কদিন সময় জীবনটা কি তাই জানা হল না ৷ 
কিন্তু সময় ফুরিয়ে গেছে ৷ কি ভাবে যে ফুরিয়ে গেল বুঝতেই পারি নাই ৷ 
হঠাৎ লক্ষ করলাম আমার টি শার্ট টি ভিজা লাগছে , নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি 
আমার সাদা টি শার্ট টা কেমন যেন হলুদ লাগছে , হলুদ ও না আবার কাল ও না… 
সোডিয়াম এর লাইট এ ওটা রক্তা না ঘামে ভিজে গেছি বুঝলাম না , কিন্তু যখন 
মাথাটা ঝিম ঝিম শুরু করল, চোখে সাদা সাদা দেখতে শুরু করলাম তখন বুঝলাম… 
ওটা সম্ভবত রক্তই হবে… নাক দিয়ে অঝোরে রক্ত পড়ছে… আমি একটু 
হাসলাম… আস্তে আস্তে  পুরো পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠছে যেন …. আচ্ছা 
অন্ধকার হয়ে যাওয়ার কথা না ? তার পর জ্ঞান হারানোর কথা না ? নাকি মারা 
যাওয়ার কথা ? 

একটু হাসলাম… ওরা কেন দৌরে পালিয়েছে এবার বুঝলাম… হাহাহাহাআআ রক্ত, সবাই ভয় পায় রক্ত ? নাহ বোধয়… 

এবার হঠাৎ সব অন্ধকার…. 

নীল আর কাল

সামনে সীমাহীন নীল ৷ যত দূর চোখ যায় চারি দিকে কেউ নেই ৷ শীতের ভোরের কন কনে ঠান্ডা  বাতাস ৷ কুয়াশা ভেজা বালু চড়ে এক মনে বসে আশে শান্ত ৷ কি যেন অজানা সব চিন্তার মাঝে হারিয়ে গেছে ৷ এভাবে কতক্ষণ বসে আছে তার কোনও হিসেব নেই ৷ গত ১ মাস এভাবেই চলছে ওর ৷ প্রতিদিন নিয়ম করে ভোর বেলায় সূর্য উঠার আগে এসে বসে  পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত এ ৷ আবার সৈকত মানুষের কল কাকলীতে ভড়ে ওঠার আগেই চলে যায় ৷ একটা বোট নিয়ে যত দূর সম্ভব চলে যায় ৷ মানুষের কোলাহলের প্রতি যেন একটা বিতৃষ্ণা জন্মেছে ওর ৷ দূরে অনেক দূরে যেখানে মানুষের কোলাহল পৌঁছে না সেখানে বোট ভাসিয়ে বসে থাকে ৷ বিশাল এই সমুদ্রের মাঝে নিজেকে তখন কত্ত ছোটো লাগে ৷ সবচেয়ে অবিশ্বাস্য লাগে রাতে ৷ বিশাল এক সমুদ্রে ঘুট ঘুটে অন্ধকার ৷ যেদিকে তাকাও অন্ধকার ৷ যেন অন্য এক জগৎ ৷ ইচ্ছে করে শান্ত বোটের লাইট গুলোও জ্বালায় না ৷ কিছু কিছু অনুভূতি আছে ভাষায় প্রকাশ করার মত না ৷ এই অনুভূতিটা হয়তো সেরকম কিছুই হবে ৷ 

বোটের এক কোনে হেলান দিয়ে শান্ত প্রকৃতিকে উপভোগ করার চেষ্টা করে ৷ কখনো সমুদ্রের ভয়ংকর গর্জনে বুক কেপে উঠে ৷ আবার কখনো মৃদু ঢেউ এ মনটা অনন্দে ভরে উঠে ৷ কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে তারার রাজ্যে হারিয়ে যায় ৷ কল্পনা আর অসাধারণ অনুভূতি মিলিয়ে কখনো গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে মনের কল্পনা  ছুটে চলে অমনি হয়তো দূর থেকে কোনও বোটের শব্দ কল্পনায় ব্যাঘাত ঘটায় ৷  তখনি আবার আরও দূরে চলে যায় আরও দূরে যেখানে মানুষের কোলাহল নেই ৷