এক
২৯ জুন ১৭৮৮,
বার্মিংহাম। ইংল্যান্ড।


সকাল থেকেই বার্মিংহাম শহরে হৈচৈ পরেছে, চার্চের ঘণ্টা বাজছে বিরামহীন। প্রায় তিন বছরের অক্লান্ত চেষ্টার পর আজ ভোররাতে বার্মিংহাম শহরের মানুষের দুশ্চিন্তা এর অবসান হয়েছে। শহর জুড়ে ত্রাস চলানো এক ডাইনি ধরা সম্ভব হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে খোদ চীনদেশ থেকে তান্ত্রিক আনতে হয়েছে ডাইনি নিধন করতে।


গত তিন বছরে শহরের অগণিত গবাদি পশু মারা পড়েছে। হাজার রকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেও লাভ হয়নি। ফার্ম হাউজগুলোর কাছাকাছিই পাওয়া যেত মৃত পশু গুলোর দেহ।  সরাসরি কোনো মানুষের ক্ষতির কথা অবশ্য শোনা যায়নি, তবে গভীর জঙ্গল থেকে মাঝরাতে ডাইনিটার চিৎকার শুনেছে অনেক মানুষ। সেই চিৎকারে নিশ্চুপ হয়ে যেত বনের ঝিঁঝিঁ পোকারাও।

মাঝে মাঝেই লোকালয়ে দেখা যেত ডাইনীটাকে। অপূর্ব সুন্দর মুখশ্রী, কিন্তু কোথায় যেন ভয়ংকর একটা কিছু লুকিয়ে আছে। নির্জীব প্রাণহীন চোখে তাকিয়ে থাকত ডাইনি টি এতেই আত্মা শুকিয়ে যেত পথচারীদের। পারতপক্ষে সন্ধ্যার পর শহরের লোকজন ঘর থেকে বের-ই হতো না বলা যায়।

সেই ভীতিকর ডাইনীকে দেখতেই আজ গোটা শহর ভেঙ্গে লোক এসেছে, তাদের সবার চোখে মুখে স্বস্তির গাঢ় রেখা। ডাইনীটাকে দেখাচ্ছে বিধ্বস্ত, চুলগুলো চলে এসেছে মুখের উপরে, হাতদুটো পেছনে বাঁধা, ঠোঁটের কোনে কেটে গিয়ে কালচে রক্ত জমাট বেধে আছে।
দুপুর ঠিক বারোটা এক মিনিটে টাউন হলের সামনে পুড়িয়ে মারা হলো তাকে।


রাতে পানশালা গুলোতে বিনে পয়সায় পান চলল। পাগলাটে বুড়ো উইলবারের উদ্ভট আচরণও শহরবাসীর মনে বিরক্তি জাগালো না। ডাইনি মরেছে, এখন আনন্দ করাই যায়!
ডাইনীটার নাম কিন্তু কেউ জানতে পারেনি, আসলে জানতে কেউ চায় ও নি।

যে আমলের কথা বলা হচ্ছে, তখন গোটা ইউরোপ জুড়েই ছিল ডাইনি নিধন নামক অসুস্থ খেলার স্বর্ণ যুগ। এরকম বিভ্রান্তকর এক সময়ে বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা সুশান রাইট কে যখন জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো তখন তার সেই আর্ত চিৎকার শোনা যায় নি । শুধু  তার পুড়ে যাওয়া শরীরের চাই গুলো মিশে গিয়েছিল বার্মিংহামের পথে প্রান্তরে। সেই ছাই গুলো হয়ত কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।


২ জুন ১৮২৩,
বাণিজ্যিক জাহাজ এইচএমএস ফ্যালমাউথ।


এক দল বণিক ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষের পথে রওনা হয়েছেন।  তাদের মাঝে একজন সোয়ান হেজ, পেশায় স্বর্ণকার। ভারতবর্ষের অলংকারের সুনাম বিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। মোটা অঙ্কের লাভের আশায় অনেক ব্যবসায়ীই পাড়ি জমাচ্ছেন বাণিজ্যিক জাহাজে চড়ে, সোয়ান হেজ তাদের মতোই একজন। দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে সোয়ান চলেছেন অচেনা এক দেশে।


জাহাজের একজন কর্মী রেনা কেপি । সংসারে নিদারুণ নির্যাতিত রেনা তার স্বামী’কে খুন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল এক শহর থেকে আরেক শহরে। সুযোগ বুঝে জাহাজে চাকরিটা নিয়েছে সে, পালিয়ে যাচ্ছে কোনো দূর দেশে।

এক শুভদিনে রেনা আর সোয়ান দুজনে দুজনের কাছাকাছি আসে। রেনা খুঁজে না পাওয়া ভালোবাসা, আর সোয়ান চায় দীর্ঘ সমুদ্রভ্রমণের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি। মনে মনে কয়েকবার দ্বিধা দ্বন্দ্ব অনুভব করে নিজের স্ত্রীর জন্যে খারাপ লাগলেও পরে সেগুলো বেমালুম ভুলে যায় সোয়ান।


রেনার  জাহাজ টির শেষ ঠিকানা ছিল ভারতবর্ষ। সেখানেই থেকে যায় রেনা।রেনার একটি মেয়ে হয়, ভারতেই থেকে যায় সে। আর ব্যবসা শেষে ফিরে যাবার সময় জাহাজেরই কিছু মানুষের হাতে খুন হয় সোয়ান হেজ। কেউ বলে ওকে স্বর্ণের লোভে খুন করা হয়েছে। আবার কেউ বলে অশরীরী আত্মা ভর করেছিল সোয়ান এর উপর। একদিন রাতে জাহাজের কাপ্তান কে  আক্রমণ করে বসে। সাত আটজন মিলেও আটকে রাখা যাচ্ছিলোনা, শেষে মাথায় গুলি করেন এক সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

২৪ জুলাই, ১৯৮১, শুক্রবার
মাইঝাটি গ্রাম।


জাবেদ সাহেবের স্ত্রীকে কবর দিয়ে আসতে আসতে ভোর হয়ে গেল৷ হাওর অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক৷ এক-একটা গ্রামে গুটি কয় ঘর, জাবেদ সাহেবদের গ্রাম এ বাড়ি আছে সর্বসাকুল্যে বিশটা৷ বছরের প্রায় সাত মাস পানিতে ঘেরা থাকে হাওড় অঞ্চলের এই গ্রাম গুলো৷ এক-একটা গ্রাম যেন বিশাল সমুদ্রে্র বুকে এক একটা দ্বীপ৷ পানি-বন্দি এই মানুষ গুলোর একমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থা হল নৌকা৷ এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে এরা সাধারণ দাঁড় বাওয়া নৌকা ব্যবহার করে আর দূরের পথের জন্যে আছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা৷ সেই ইঞ্জিন চালিত নৌকার অবস্থাও যে খুব বেশি উন্নত তা না৷ শীত কালে যখন ৪-৫ মাসের জন্যে পানি নেমে যায় এই এলাকার মানুষেরা তখন চাষবাস করে৷ পানি নেমে যাওয়ায় এক বিশাল ফাঁকা অঞ্চল সৃষ্টি হয়, এক প্রান্তে দাঁড়ালে যার আরেক প্রান্ত দেখা যায় না৷ এলাকায় তখন যেন প্রাণের সঞ্চার হয়- বর্ষা কালের মাঝিরা হয়ে যায় কৃষক, নৌকার ইঞ্জিন গুলো হয়ে যায় ক্ষেতের পানি সেচের পাম্প৷


শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়স্বজনের অনুরোধে স্ত্রীর কবরটা নিজের শ্বশুরালয়েই দেয়াড় জন্য মনস্থির করলেন জাবেদ সাহেব। যেহেতু গ্রাম দেশ, সারা রাত লাশ নিয়ে বসে থাকার মানে নেই৷ মুরুব্বিদের তাগাদাও চলতে থাকে মৃতকে দ্রুত কবর দেয়াড় জন্য৷ যত দ্রুত কবর দেয়া হবে ততই মঙ্গল৷এই গরমের  রাতে সারা রাত লাশ টেকানো যাবে না, এই শঙ্কা টি রয়েই যায় । অগত্যা রাতেই কবর দিতে রওনা হতে হলো ।


সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে মাইঝাটি ফিরতে ফিরতে এখন রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো বলে।
ওদিকে মা মরা মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে শেষ । সকাল থেকে একটানা আহাজারি করতে করতে এখন গলা স্তিমিত হয়ে আসছে, তবু এক অস্পষ্ট গোঙানি শোনা যায় । মা  মরা মেয়ের সেই কান্নার শব্দ কাঁপন ধরায় বুকে, হাহাকার সৃষ্টি কর ।


জাবেদ সাহেব অনেক চেষ্টা করেও মেয়ের কান্না থামাতে পারলেন না৷ তাঁর বোন রাশেদা বললো,


‘ভাইজান ওরে আমি দেখছি, আপনে যান, একটু বিছানায় শরীরটা লাগান। কাইন্দা কি ফায়দা অখন কন?’


জাবেদ সাহেব গেলেন৷ কিন্তু ঘুম হল না৷ সেদিন দুপুর পর্যন্ত কান্না চললো  জাবেদ সাহেবের মেয়ের।

দুই
আজ ছয় বছর পর বাড়ি ফিরছে অকিল৷ ছয় বছরকে খুব একটা বড় সময় মনে না হলেও বিদেশের মাটিতে ছয় বছর কি তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়৷ অকিল দেখতে মোটাসোটা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা৷ চশমার ডাটিটা একটু ঢিলে, বার বার নাক দিয়ে পিছলে পড়তে থাকে। অকিল একটু পর পর তা হাতের তালু দিয়ে ঠিক করে৷ দুই মাস ধড়ে চশমাটা পাল্টাবে ভাবলেও পালটানো হচ্ছে না৷ গত তিন ঘণ্টা ধড়ে নৌকাতে বসে আছে ও৷ নৌকাটা চালু হওয়ার পর ইঞ্জিন এর ভট ভট শব্দ কানে ধরছিল খুব৷ অসহ্য রকম শব্দ৷ এতক্ষণ ধড়ে বসে থেকে এখন সেটা অনেকটাই স্বাভাবিক লাগছে, তবে মাথা টনটন করছে। নির্ঘাত মাথা ব্যথা শুরু হবে৷ বাড়ি পৌঁছাতে আরো ঘণ্টা দুই বাকি৷ মাথা ব্যথা আজ নিশ্চিত৷ বাড়ি আসবার আনন্দ সব উবে যাচ্ছে এই ভটভট শব্দ আর মাথার দপদপানিতে। এই জীবনে অকিল খুব কম জিনিসই ভয় পায়৷ মাথা ব্যথা তার মাঝে একটা৷ একবার শুরু হলেই হলো, ব্যথার চোটে তখন না যাবে শোয়া না যাবে বসা।মাথা ব্যথা থেকে মন ঘুরানোর জন্য পাশে বসা পাশে বসা গ্রাম সম্পর্কের চাচা কলিমুদ্দীনকে বললো অকিল,


‘চাচা, গ্রাম টা তো বোধহয় একদম বদলে গেছে না? চিনব নাকি নৌকো থেকে ?’

কলিম চাচা একটু হেসে বললেন,

‘বাজান, মনে হয় না চিনবা, অনেক টুকু ভাঙ্গা পরেছে নদীতে, ঘর বাড়ি বদলিয়েছে, বুঝোই তো, মেলা দিন পার হইলো তুমি যাওয়ার পরে। কদ্দিন বাদে জানি ফিরলা?’


‘এইতো চাচা, ছয় বছর হবে।’


‘তাইলে বোঝো!’

উনার সাথে একমত হয়ে মাথা নাড়ল অকিল৷ এখন শীত কাল৷ পানি অনেকখানি নেমে গেছে৷ চাচা জানালেন আর কিছুক্ষণ পর নৌকা যাবে না৷ প্যাঁক-কাদা মাড়িয়ে হাঁটতে হবে৷ গ্রামের এই জিনিসটা এখনো বদলায়নি!

‘বাবা হাঁটতে পারবা তো?’ শুধালেন কলিমুদ্দিন।

‘জি চাচা। কি বলেন এইটা? পারব না আবার!’

‘তাইলে জিনিস পত্র কাইচ্চা লও, আর বেশি দেরি নাই।’

দুই মাঝি অনেক কসরত করে নৌকা ঘাটে লাগালো৷ ঘাটটা যে অস্থায়ী সেটা বোঝাই যায়৷ নামতেই কাঁদার মাঝে পা ডুবে গেল অকিলের। দুইশো’ ডলারের নাইকি জুতা, বুকটা খচ করে উঠলো অকিলের৷ একটু সামনে এগিয়ে জুতা খুলে প্যান্টের বেল্ট বাঁধার জায়গায় বেঁধে নিলো সে, এতে হাঁটার গতিও বেশ বাড়ল৷ হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করল ওর বয়সী একটা ছেলে ওর পাশাপাশি হাঁটছে৷ ভাল করে তাকাতে কেমন চেনা চেনা লাগলো।

‘কিরে তুই সাগর না?’

‘শালা, চিন্তে পেরেছিস তাহলে!’

‘কি বলিস, পারবো না আবার!’

বলে একজন আরেকজন কে জড়িয়ে ধরল৷ খুব বেশি বন্ধু অকিলের কোনো কালেই ছিল না। সবার মধ্যে সাগর ছেলেটাই ছিল অন্যরকম। খুব বিশ্বস্ত ছেলে, তাই ঘনিষ্ঠতাও বেশি ছিল। আজ ছয় বছর পর সামনাসামনি দেখা, বুকটা ভরে গেল অকিলের।

তিন

গ্রামের বাড়িতে রাত নয়টা মানে নিশুতি। কিন্তু আজ তেমন মনে হচ্ছে না। ঘর ভর্তি মানুষ। সবার উৎসাহ অকিল কে নিয়ে। এই ঘর ঐ ঘর করে এক এক বাড়ি থেকে এক এক জন আসছে। কেউ আসছে পিঠা, কেউ টাটকা মাছ বা সবজি আবার কেউ আসছে ঘরে পাতানো খাঁটি ঘি নিয়ে। এতো আতিথেয়তা দেখে মনটা ডুকরে কেঁদে উঠল অকিলের। এমন একটা দেশে ছয়টা বছর কাটাতে হয়েছে, যেখানে বিনে পয়সায় একটা দানাও কেউ কখনো দেয় নি।

দেশের বাইরে যাওয়ার পর এক বাঙালি আত্মীয়ের বাসায় প্রথম উঠে সে। বাড়ির কর্তা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, নেহাত অকিলের বাপের কাছে ঋণী তাই জায়গা দিয়েছেন। দুই দিনের মাঝে নিজের ব্যবস্থা করে সরে পড়তে হবে। দু’দিন পরেও যখন কোনো থাকার জায়গার ব্যবস্থা হয় নি, তখন আরো পাঁচদিন থাকার জন্য গুনে গুনে এক সপ্তাহের ভাড়া হিসেবে সত্তর ডলার দিয়ে আসতে হয়েছে তাকে। বাড়ির স্টোররুম হিসেবে ব্যবহার হওয়া একটা ঘরে শুরু হয়েছিল অকিলের প্রবাস জীবন।

‘কিরে কি ভাবছিস?’ পিঠে সাগরের চাপড় খেয়ে সম্বিত ফিরলো অকিলের।

‘কিছু না রে বন্ধু, ভাবছিলাম এতো মায়া ছেড়ে কেন বাইরে গিয়েছিলাম!’

‘শালা ভীমরতি ধরেছে নাকি, হ্যাঁ? এতো ভালো দেশ এতো উন্নত দেশ আর তুই মায়ার কথা বলিস! কি আছে তোর নিজের দেশে? আমার কথাই ধর। এই যে পুলিশ এর চাকরি করি, কয় টাকা বেতন পাই? বেতনের টাকায় মাসের কয়দিন যায় শুনবি?’

‘আচ্ছা ভায়া, বাদ দে। ভাল কথা তোর বোন কোথায়?’

‘আজ আসতে পারেনি রে, একটু ঝামেলা আছে। কাল আসবে। জাবেদ দের বাড়িতে ও একটু সাহায্য করছে, ওদের বড় বিপদ৷’

‘সে কি? কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?’

‘জাবেদ কে তো চিনিস, আরজ চাচার ছেলে।’

‘হু, চিনি। ভালো ফুটবল খেলতো। শুনলাম জাবেদের বউটা মারা গেছে। এতো অল্প বয়স মেয়েটার, খারাপ লাগলো খুব।’

‘জাবেদের একটা মেয়ে হয়েছে জানিস বোধহয়, রীতি নাম।’

‘হ্যাঁ, ওকে তো তিন-চার বছরের দেখে গিয়েছিলাম।’

‘হ্যাঁ, আর বলিস না। মা মারা যাবার পরপর এই মেয়ে কে জ্বীন ধরেছে!’

‘আরে ধুর, ফাজলামি করার জায়গা পাস না! জ্বীন ধরেছে? শালা ভেবেছিস গ্রামে এসেছি অনেক দিন পর ,ভয় পেয়ে যাব! না?’

কথা টা বলতে বলতে একটা অট্টহাসি দিল অকিল। পরক্ষণেই লক্ষ্য করল সাগরের মুখটা কালো হয়ে গেছে। বোঝাই যায়, ব্যাপারটা নিয়ে সে বেশ সিরিয়াস। নিশ্চয়ই কোথাও ঘাপলা আছে। জিন-ভূত এ অকিলের কোনো বিশ্বাস নেই। ও ভীষণ বাস্তববাদী মানুষ।

‘বন্ধু তুই তো আমাকে চিনিস তাই না? আর তুই এটাও জানিস আমি ভীষণ বাস্তববাদী মানুষ। এসব জ্বীন-ভূতে  আমি বিশ্বাস করি না।  তবে তোরা যেটাকে জিন-ভূত বলে চালিয়ে দিস সেটাকে আমি বলি unexplained phenomenon. এখন তুই বলতে পারিস যাহা unexplained phenomenon তাহাই ভূত। দুটোর শুধু দুই নাম। কিন্তু ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তা না। ধর তুই আকাশে উজ্জ্বল একটা বস্তু ভাসতে দেখলি। ওটা প্লেন না তুই নিশ্চিত, এখন তুই বললি ওয়াও এটা নিশ্চয়ই ফ্লায়িং সসার।  আমার কথা হল ভাই তুই জানিস না ওটা কি। এখন ওটা প্লেন না হলেই ফ্লায়িং সসার হবে কেন? একইভাবে তুই বলতে পারিস না রীতিকে জ্বীনে ধরেছে। ওর আচরণ অস্বাভাবিক মনে হলে বলতে হবে অস্বাভাবিক আচরণ। জিন-ভূত বলে সব কিছুকে লেবেল দেয়া খুবই যুক্তিহীন একটা কাজ।’

‘ভাই তোরা অনেক পড়া লেখা করেছিস অনেক জ্ঞান গরিমা। আমরা তোদের সাথে কথা বলে পারবো কেন।’

কথা টা বলে মনে মনে ভীষণ রাগ করল  সাগর৷

‘আরে ভাই তুই দেখি ব্যাপারটা পার্সোনালি নিলি। শোন তাহলে বলি কি, আমি কাল দেখতে যাব রীতি কে। আচ্ছা বল তো সমস্যাটা কি? কেন তোদের মনে হলো মেয়েটাকে জ্বীনে ধরেছে?’

‘সে তো অনেক বড় গল্প…’

‘আরে শুরু কর, এতদিন পর এলাম আজ! আড্ডা দিয়েই পার করে দিবো সারারাত!’

‘সে কি, এতো ধ্বকল সহ্য করে এতো দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এলি। বিশ্রাম নে তো, কাল সকালে অনেক কাজ আছে, বিকালে তোকে নিয়ে যাবো ওখানে। যাবার পথে গল্পটা শোনাব তোকে।’

সাগর চলে গেল, অনেক অনুরোধের পরও রাতে খেয়ে গেল না। সম্ভবত রাগ করেছে, মনে মনে ভাবল অকিল। হয়ত এতো কড়া ভাবে বলা ঠিক হয় নি। গ্রাম গঞ্জের মানুষ অনেক সাদাসিধা, সহজ তাদের জীবন বোধ। unexplained phenomenon জাতীয় তত্ত্বকথা চাইতে  ভূতে বিশ্বাস করে ফেলাটাই এদের কাছে সহজ, এটা বোঝা উচিত ছিল অকিলের। কিন্তু কি করবে উলটা পালটা কিছু দেখলে সেটা ধরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত অস্বস্তি  লাগে তার। নিজের কাছেই খারাপ লাগতে থাকল। ওদিকে অকিলের মা মালতী দেবী দু’বার খেতে ডেকে গেছে, এ নিয়ে তৃতীয় বার এলেন-

‘ও বাবা, দুই চাইর দানা মুখে কিছু দে, ও মা সাগরটা গেলো কই? বলি, ছোট ঘরে গেল নাকি?’

‘না মা, সাগর বাড়ি চলে গেছে।’

‘হায় ভগবান, চলে গেলো মানে টা কি? তুই আসলে কি কি করবে কি কি খাওয়াবে গত দুই তিন মাসে তো সেই গল্প করেই আর রাখে না, এখন চলে গেল? বুঝি না বাপু।’

রাগে মালতী দেবী গজ গজ করতে চলে গেলেন। উনি যত টুকু রাগলেন তার থেকে বেশি কষ্ট পেলেন। মালতী দেবীর মনে হচ্ছে অকিল বদলে গেছে। উনার সন্দেহ হচ্ছে উনাকে না জানিয়ে বিয়ে টিয়েও হয়ত করে ফেলেছে। নির্ঘাত ইনিয়ে বিনিয়ে কোনো একদিন বলে বসবে মা বিয়ে করে ফেলেছি। কোনো সাদা চামড়ার মেয়েকেই হয়ত ঘরে তুলতে হবে। এমনই পোড়া কপাল, ছেলেটাও তাহলে বিদেশেই থিতু হবে। ভাবতে ভাবতে অকিলের মা কেঁদেই দিলেন।

ওদিকে অকিলের এতো মানুষের হৈচৈ  ভাল লাগল না। কেন যেন মনে হলো সাগর যায় নি। এতো দিন ধরে বসে আছে ওর জন্যে আজ হুট করে চলে যাবে? যেতেও পারে, মানুষের আশা যত বেশি, উত্তেজনা যত বেশি, সে কষ্টও পায় তত বেশি।

বাড়ির বাইরে যেতেই সাগরকে পাওয়া গেল৷ বাড়ির সামনে একটা গাছে হেলান দিয়ে বিড়ি টানছে৷ অকিল পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই পকেট থেকে আরেকটা বিড়ি বের করে দিল অকিলকে৷

‘বিড়ি খাওয়াটা এখনো ছাড়তে পারলি না রে ? সিগারেট খেলেই পারিস৷’

‘সিগারেট বিড়ি, টমেটো টমেটো, একই জিনিস ভায়া।’

‘হু, তা বটে।’

‘ঘাটে যাবি নাকি? আগের মত নেই অবশ্য।’

‘যাই চল।’

‘এতো শীত আগে পাইনি রে?’

’এই এটা তোর মানিব্যাগ নাকি রে?’ বলে একটা মানিব্যাগ সাগরের পায়ের কাছ থেকে তুলে দিল অকিল৷

‘হু, বিড়ি বের করতে গিয়ে পড়ে গেছে মনে হয়৷ তুই শীতের দেশ থেকে এসেও শীতের কথা বলছিস?’

‘হু, এখানের শীত আর ঐ শীত এ অনেক তফাত । আচ্ছা গ্রাম টা পুরো বদলে গেছে না রে?’

‘হু, তবে, সাদেক চাচার দোকানটা কিন্তু এখনো আছে ঘাটের পাশে।’

‘তাই নাকি, মরে নি ঐ বুড়ো?’

‘নাহ! তোর কাছে কুড়ি টাকা পায়, ওটা না নিয়ে কবরে যাচ্ছে না’

‘আজ সব পাওনা মিটিয়ে দেব, কি বলিস?’

‘হাহা, ব্যাটা সুদ চায় কিনা দেখ, দেখা যাবে বিশ টাকা দুই হাজার টাকা হয়ে গেছে৷ ছয় বছরে সুদ কম হবে না৷’

সাদেক চাচাকে অবশ্য পাওয়া গেল না, যাকে ঐ দোকানে পাওয়া গেল সে হচ্ছে সাদেক চাচার ছেলে, আবুল।  আবুলের বয়স নয়-দশ হবে৷ ওকে ছোট দেখে গিয়েছিল অকিল৷ আবুলের দিকে তাকিয়ে চায়ের ফরমাশ করলো সাগর।

‘আচ্ছা বন্ধু বল দেখি রীতি মেয়েটার কেইসটা কি?’

সজোরে বিড়িতে একটা টান দিয়ে অকিলের হাতে বিড়িটা গুঁজে দিয়ে শুরু করল সাগর।

‘গতবারের বর্ষাকালের কথা, সেটা ছিল বৃহস্পতিবার। কোনো কারণে জাবেদ ভাই তার বউয়ের সাথে ঝগড়া করলেন। সময়টা ধর আনুমানিক মাগরিবের আজানের আধ ঘণ্টা আগে। জাবেদ ভাই বাড়ি এসে দেখলেন রীতির মা শুয়ে আছে, তার মেয়ে ডাকছে মা উঠো উঠো। উনি ভাবলেন বউ হয়ত রাগ দেখাচ্ছে। উনি রাগ ভাঙাতে গিয়ে দেখলেন তার বউয়ের শরীর একদম নিথর। কোনো রেসপন্স নাই। মারা গেছে।’

‘বলিস কি, মাই গড!’

‘এটা তো কিছু না, সমস্যা শুরু হয়েছে এর পর।’

‘মানে?’

‘জাবেদ ভাইয়ের বউকে রাতেই কবর দেয়া হল, ভাবির বাপের বাড়িতে। জাবেদ ভাইয়ের ফিরতে ফিরতে সকাল, মানে ভোর হয়ে গেল আরকি। কিন্তু উনার মেয়ে তো ছোট। সে তার মায়ের জন্যে হুলুস্থুল কান্নাকাটি শুরু করল। বাচ্চা মেয়ে কি আর বোঝে। কান্না আর থামে না। দুপুরের দিকে জাবেদ সাহেব খুব রাগ করলেন। মেয়েকে একটা চড় মারলেন। মেয়ের কান্না থামলোও সেই চড় খেয়ে। এরপর মেয়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ঘুম আর ভাঙে না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত,  তারপরের দিন ভোর হয়ে এলো- মেয়ের ঘুম ভাঙে না। দুপুরে মেয়েকে নিয়ে তারা রওনা হলো সদর হাসপাতালে৷ নিতে নিতে রাত। মেয়ের ঘুম ভাঙছে না। ডাক্তার বলে কোমায় চলে গেছে। আরেকজন young ডাক্তার সে বলে না এটা কোমা না। সিনিয়র ডাক্তার আর তরুণ ডাক্তার এর মাঝে মনোমালিন্য। গভীর রাতে দেখা গেলো মেয়ে বিছানার চাদর খেয়ে ফেলেছে। গায়ে ভীষণ শক্তি। ৪ জন মিলে আটকে রাখা যায় না। পাশের রোগীর আস্ত কলার কাঁদি খোসা সহ খেয়ে নিল, তেলের কৌটা বোতল সহ কামড়ে খেয়ে ফেলল। কেমন ফ্যাকাশে চেহারা চোখ এ কোন প্রাণ নাই৷ নির্জীব ভাবে তাকিয়ে থাকে, দেখলে মনে হবে কোনো মৃত মানুষ হাঁটছে-খাচ্ছে। খেয়ে হঠাৎ ই শরীর টা নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। টানা আরো ৬ দিন এমন চলল। কোনো রাতে উঠে খেত কখন ও উঠে না। ৬ দিন পর সেই ঘুম ভাঙল । মেয়ে এসব কিছু ঘুম ভেঙে বলতে পারে না। শুধু বলে। মা এর কাছে নিয়ে চল। মা ঢাকায়। মা এর কাছে যাব। মা ভুতের গালে ভুতের গালে। গাল জিনিস টা কি আমরা কেউ বুঝলাম না। সেটা কি মুখের গাল? কি বুঝতে চায়, ভূত খেয়ে ফেলেছে মা কে? না কি আমরা কুল কিনারা পেলাম না।

ডাক্তার রা চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। বললেন বাড়ি নিয়ে সৃষ্টিকর্তা কে স্মরণ করতে, তারা অপারগ। এখানেই শেষ না ৪ মাস গেল ভালোই। শুধু মা এর কাছে যাবে এটা বলে। আর উদ্ভট কথা বলে। কোনো মানে হয় না সেগুলোর। চার মাস পর আবার একই ঘটনা। কিন্তু এবার আরো মারাত্মক। গত দু মাস ধড়ে সেই মেয়ে ঘুমাচ্ছে। কখনো ছয় সাত দিন, আবার কখনো এক দুই দিন পর পর গভীর রাতে জেগে উঠে, সামনে যা পায় খেয়ে ফেলতে চায়। হেনো কিছু নাই যে খায় না। একদিন রাতে বেড়িয়ে মুরগি এর খোপ থেকে জীবন্ত মুরগী কাঁচা খেয়ে ফেলেছে তিন চার টা। ভয়ংকর বেপার।’

এক নিশ্বাস এ কথা গুলি বলে গেল সাগর। মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে শুনল  অকিল। নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে। নিজের কান কে বিশ্বাস হচ্ছে না। এও কি সম্ভব? ২ মাস ধড়ে একটা মানুষ ঘুমায়?

চার
পরের দিন আর যাওয়া হল না অকিল এর৷ কোনো একটা কারণে সাগর কাজে আটকে গেছে৷ সে আসতে পারল না৷ অকিলের মন টা বিক্ষিপ্ত ভাবে এই চিন্তা ঐ চিন্তা করছে৷ কিন্তু কোনো কিছুতেই মন বসছে না৷  সাগর এর বলা  ঘটনা টা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না৷ নিশ্চয়ই এর কোনো ব্যাখ্যা আছে৷ ভূত নিশ্চয়ই না,  ভূত বলতে আমরা যা বুঝি তা থাকতেই পারে না৷ এদিকে বাড়িতে কোনো কাজ নাই৷ কি করবে, সময় কাটে না৷ মাঝে কিছু বাই পত্র নিয়ে পড়া শোনা করল৷ কিন্তু ঐ যে ওর মাথায় একটা জিনিস ঢুকেছে৷ এখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না৷

সেদিন রাতের কথা৷ গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল অকিলের৷ ঘরের আশেপাশে কোনো শব্দ হচ্ছে মনে হল৷ নিশ্চয়ই কোনো জীব জন্তু হবে৷ চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল অকিল৷ কিন্তু মনে হল শব্দ টা হচ্ছে৷ একটা নির্দিষ্ট  তালে ৷

একটা আর্ত-চিৎকার, তার পর কিছুক্ষণের বিরতি৷ মনে মনে সেকেন্ড হিসাব করল অকিল৷ ২ সেকেন্ড৷ আবার চিৎকার টা শোনা গেল৷ হাওর অঞ্চল, এখানে অনেক দূরের শব্দ বাতাস আর পানিতে করে ভেসে আসে  মনে মনে ভাবল অকিল, কোথায় না কোথায় হচ্ছে ধুর ঘুমাই৷ আবার হল,  আবার ২ সেকেন্ড পর আবার, এবার সুর একটু পাল্টেছে৷ এভাবে চলতেই থাকল৷ অকিল চোখ বন্ধ করে থাকল, বোঝার চেষ্টা করল এটা কি ওর মনের ভুল নাকি আসলেই হচ্ছে শব্দটা৷ এক সময় মনে হল ও কি ওর নিজের মনের ভুল না তো ? তো নিজের ভ্রম কাটানোর চেষ্টা করল৷ ঘুমের ঘোর আছে কিনা বুঝতে চাইল,  না সেটা তো হতে পারে না৷ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে  শব্দটা ঘরের বাইরে থেকে৷

এক সময় যখন আর পারল না উঠে পড়ল বিছানা থেকে৷ অন্ধকার ঘরে এদিক ওকিদ হাতড়ে হারিকেন টা পাওয়া গেল৷ হারিকেন টা জ্বালিয়ে মনে হল শব্দটা আরেকটু দ্রুত হচ্ছে৷ ২ সেকেন্ড এর বিরতিটা মনে হয় এখন আধা সেকেন্ড হয়েছে, এক সেকেন্ড ও হতে পারে৷ বোঝা যাচ্ছে না৷ একটা ডিজিটাল ঘড়ি ওর আছে সেটা এই অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না৷

ঘরের দরজা টা খুলতেই একটা ঠান্ডা বাতাস ওকে ধাক্কা দিল৷ শরীরের হাড় সহ কেঁপে উঠল৷ এটাকেই মনে হয় বলে হাড় কাঁপানো শীত৷ অকিলের ঘর টা জমি থেকে কিছুটা উঁচুতে৷ নতুন বাড়ি, নামতে গিয়ে খেয়াল করেনি৷ ধুপ করে পড়ে গেল৷ হারিকেন টা হাত থেকে পড়ে গেল৷ অকিলের মাথা টা ঠুকে গেল বাড়ির সামনে রাখা একটা  লোহার বালতি তে৷ ব্যথায় মাথা টা টন টন করে উঠল অকিল এর৷ নিশ্চয় কেউ বাথরুম এ যাওয়ার জন্য পানি আর বালতি রেখেছিল ঘরের সামনে৷ আছাড় খেয়ে হারিকেন টা নিভে গেছে৷ বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ কষ্টে শিষ্টে উঠে বসল অকিল৷ অনেক মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা হয়ে যেতে পারত অকিল এর৷ মাথা ঠুকে কত মানুষ মারা যায় প্রতি বছর৷ কত মানুষ যায় ? এর নিশ্চয় কোনো  স্ট্যাটিস্টিক আছে৷ দেখতে হবে খোঁজ নিয়ে৷ মাথা টা ভীষণ ব্যথা করছে৷ হাত দিয়ে কপালে বুঝতে পারল রক্ত পড়ছে৷ শরীরের চাদর টা দিয়ে কপালে চেপে ধরল৷ ফাটেনি নিশ্চয়ই , ফাটলে জ্ঞান থাকার কথা না৷  চামড়া ফেটে কেটে গেছে হয়ত৷ বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা বুঝল মা কে ডাকতেই হবে৷ শরীর টা বিশেষ ভাল লাগছে না৷ কেমন যেন বমি আসছে৷ কিন্তু উঠতে গিয়ে পারল না৷ মাথা ঘুরাচ্ছে৷ অনেক রক্ত বের হয়েছে হয়ত ভাবল অকিল৷ শেষে চিৎকার করে ডাকল মা মা ও মাআ৷ তিন বার ডেকে কি যেন একটা মনে পড়ল অকিলের , কিন্তু কি যে মনে পড়ল কি যেন মাথায় আসি আসি করেও আসল না৷ কি যেন একটা ও ধরতে পেড়েছে, বুঝতে পেড়েছে  কিন্তু সেটা কি? নাহ, কিছুতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হচ্ছে না৷ তবে অকিল যে জিনিস টা খেয়াল করল না তা হল চিৎকার টা থেমে গেছে … শব্দটা থেমে গেছে এখন আর হচ্ছে না৷

পরের দুদিন জ্বরে কষ্ট করল অকিল৷ তৃতীয় দিন কিছু টা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারল ও৷ সেদিন সাকালেই ঠিক করল আজই যাবে ও দেখে আসবে রীতির সাথে৷ এই দুই দিন জ্বরের ঘোরে তেমন কিছু করতে পারে নি ও৷ মাঝে মধ্যে প্যারাসিটামল খেয়ে যখন জ্বর কমেছে তখন রীতির কথা ভেবেছে অকিল৷ ব্যাপার টা ও কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছে না৷

সকাল দশটার দিকে সাগর এল৷

‘জ্বরে তো মরতে বসেছিলাম ভায়া, তুই তো এসে দেখা ও করলি না৷ কিছু হয়েছে নাকি?’

‘হ্যা রে, শালার এক মন্ত্রী এসেছে, তার ডিমান্ড এর শেষ নাই৷ চাকরি নিয়েছি পাবলিক এর আর সেবা করি কাদের! তা তোর খবর শুনলাম কাল রাতে তাই আজ চলে এলাম৷ হয়েছে কি’

‘ভায়া বাথরুমে যেতে যেয়ে পড়ে কি বিচ্ছিরি অবস্থা বল৷ বালতি টা কপালে ঠুকে গেল!’

‘কদিন শহুরে জীবন যাপন করে তুই কি যে হয়েছিস৷ রেস্ট নে নড়া চরা করবি না৷ সুস্থ হ’

‘না রে আজ তোর রীতির কাছে নিয়ে যেতে হবে৷’

‘বলিস কি রে? তোর পাগলামি গেল না৷ আগের মতই আছিস৷ ডিটেকটিভ হওয়ার শখ টা যখন এত আমার মত পুলিশে যোগ দিতি৷ এখনো সময় আছে কুয়ালিফিকেশন তো ভাল যোগ দিয়ে দে৷’

‘আরে ধুর ও সব চাকরামি করতে পারব না৷ নে ধর উঠা, স্নান টা করেই রওনা দিব৷ তুই জল খাবার টা খেয়ে নে, মা কে বলে রেখেছি তোর প্রিয় দুধ চিতল বানিয়েছে যা৷’

পাঁচ

বিশাল একটা নৌকাতে মাত্র পাঁচ জন মানুষ৷ ২ জন মাঝি, অকিল, সাগর আর তার বোন সাহেদা৷  কুয়াশাতে ২ হাত সামনে ও কিছু দেখা যায় না৷ অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে অকিল এর৷ ও শুধু সাগর আর ওর বোন কে দেখতে পাচ্ছে৷ নৌকার দুই মাথার দুই মাঝি কে ও দেখা যাচ্ছে না৷ অদ্ভুত ব্যাপার, মাঝি রা ঠিক পথে যাচ্ছে তো ? মনে মনে যখন এই কথা ভাবছিল সাহেদা বলে উঠল

‘ভাই চা দিব?’

অকিল বেশ আনমনে ছিল শুনতে পায় নি৷ সাহেদা তার ভাই কে একটা গুঁতা দিল৷ এবার সেই গুঁতা এসে পড়ল অকিলের কাঁধে৷

‘কি, চা হবে?’

‘হুহু, দে দে’ জবাব দিল অকিল

সাহেদা সবাইকে চা দিল৷ দুজন মাঝি তারাও পেল৷ চা খাওয়ার বিরতি চলছে তাই নৌকা খুব ধীরে চলছে৷ ডানে বায়ে একটু দুলছে৷ মাঝে মাঝে ঢেউ এর বাড়িতে অল্প বিস্তর ছলাত ছলাত শব্দ হচ্ছে৷ এ ছাড়া পুরোটা পরিবেশ নিস্তব্ধ নীরব৷ মাঝে মাঝে নীরবতায় কানে তালা লেগে যায়৷ এখনকার দুনিয়াতে যে পরিমাণ হৈ চৈ কোলাহল তাতে এই অনুভূতি একই সাথে স্বর্গীয় আবার অস্বস্তিকর অচেনা একটা অনুভূতি মনে হল৷ কানের পেশে যেন একটা ঝি ঝি শব্দ কান দুটোকে চাপ দিয়ে রেখেছে৷ যত সময় যায় তত ভাল লাগে কিন্তু অস্বস্তি তত বাড়ে৷ নীরবতা ভাঙ্গল সাহেদার মিষ্টি কণ্ঠ৷

‘ভাই আপনার কথা অনেক শুনেছি, মাঝে মধ্যে মনে হত আপনি আমাদের পরিবারেই থাকেন৷’

‘তাই নাকি? কিরে সব সিক্রেট ফাঁশ করে দিয়েছিস ?’

‘আর ধুর কি বলিস, নাহ তেমন কিছু না৷ আমার তোর গল্প করি এই আরকি স্মৃতি তো আর কম না৷’

‘তা আপু, রীতির গল্পটা শুনেছেন নাকি?’

‘জী ভাই, আপনার বন্ধু ভাবে জীন ভূতের কারসাজী’

‘আপনি ভাবেন না? আপনার কি মনে হয় ?’

‘ভাই জীন ভুত কিনা জানি না, তবে এইটুকু বলতে পারি এভাবে এই অজপাড়া গাঁ এ ফেলে রেখে এই সমস্যার সমাধান হবে না৷ দুনিয়া কত এগিয়েছে কেউ না কেউ ঠিক করে বলতে পারবে কি হয়েছে৷’

‘অসাধারণ বলেছেন আপু বাই দা ওয়ে আপনার চা টা বেশ হয়েছে৷ কথাটা অবস্য বানিয়ে বল্ল অকিল৷ চা টা জঘন্য৷ কিন্তু প্রশংসায় বেশ লজ্জা পেলেন উনি৷ ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গেল৷ সাগর কারো দিকে তাকাচ্ছে না দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে৷ মানুষ লুকোতে চাইলে এমন করে৷ চোখের দিকে তাকায় না৷ চোখ অনেক কিছু বলে দেয়৷ তিনজনের কথা বার্তা আরো দুই ঘণ্টা চল্ল৷ যখন ওরা পৌঁছুল অকিলের শরীর বেশ ভাল লাগছে৷ রীতিদের বাড়িতে যেয়ে জাবেদ সাহেব কে পাওয়া গেল না৷ তবে রীতির দাদা কে পাওয়া গেল৷ তিনিই নিয়ে গেলেন রীতির রুমে৷ ভীষণ রোগা একটা মেয়ে বিছানায় পড়ে আছে শরীরে একটা কম্বল দেয়া৷ অকিল জিজ্ঞেস করল হাত পা বেধে রেখেছেন ?

‘হ বাবা, করুম, কিছু করার নাই৷ গত রাতে এক ছোট বাচ্চার গলা টিপা ধরেছে , আল্লাহ্‌ সহায় নাইলে বাচ্চাটা রে বাঁচানো যেত না৷’

‘আজ কত দিন হল এমন?’

‘বাবা ২ মাস ১৭ দিন’

‘জাবেদ সাহেব আসবে কখন বলতে পারেন?’

‘তার আসতে বাবা আজ সন্ধ্যা হবে’

‘ওনার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিল’

‘অবশ্যই কথা হবে, তুমি এ বাড়ির মেহমান আমার নাতনীকে দেখতে আহিস৷ আজ রাতে তোমরা তিনজন থাইক্কা যাও৷ যত্ন আত্তির কোনো কমতি হবে না৷’

বুড়োর কথায় রাজি হল অকিল৷ যেই কথা সেই কাজ৷ বিদেশ ফেরত কোনো মানুষের বোধয় অনেক কদর এদেশে৷  দুই পদ এর মুরগী , খাসি, পোলাও, চার পদের মাছ দিয়ে খাবার দেয়া হল৷ এত খাবার কি মানুষ খেতে পারে ? মনে মনে এটা ভেবে আশ্চর্যিত হল৷ এভাবে আশা আর থাকা টা ঠিক হচ্ছে কিনা তা ও এখন ভাবাচ্ছে অকিল কে৷ সে কোনো ডাক্তার না, না কোনো ফকির বা ওঝা৷ মেয়েটাকে সারানোর কোনো ক্ষমতা ওর নেই৷ নিজের কিউরিসিটি থেকে এসেছে৷ গ্রামে মানুষের ঢল পড়ে গেছে অকিল কে দেখতে৷ বিদেশ ফেরত মানুষের মাঝে কি আলাদা আছে ও বুঝতে পারল না৷ এত খাবার এর কিছুই খেতে পারল না ও৷ অতি শোকে পাথর আর অতি খাবারে অভুক্ত৷

এর মাঝে রীতি  এর হাত পা থেকে সেঁকল খোলা হল, গরম পানি দিয়ে তার সাড়া শরীর মোছা হল, নোংরা জরাজীর্ণ কাপড় খুলে ভাল পাড় পড়িয়ে দেয়া হল৷ খাওয়ার পর্ব শেষ করে অকিল এসে মেয়েটার পাশে বসল৷ মেয়েটার কব্জিতে হাত দিয়ে পাল্স দেখল৷ পাল্স বেস ধীর গতির৷ তার পর মেয়েটার চোখ পরীক্ষা করল৷ চোখের পাতার উপর দিয়ে বোঝা গেল ভেতরে চোখের মনি নড়ছে৷ তার মানে মেয়েটা স্বপ্ন দেখছে৷ ব্যাপার টা ইন্টারেস্টিং মনে হল  অকিলের৷ কতক্ষণ এমন মনি নড়ে খেয়াল করতে হবে৷ স্বপ্নের দৈর্ঘ্য কত তা বোঝা দরকার৷ পুরোটা সময় ই কি স্বপ্ন দেখে নাকি মাঝে মধ্যে এটা খুব জরুরী৷ যদিও অকিল ডাক্তার না কিন্তু ও পরিষ্কার বুঝল মেয়েটার সমস্যা খুব জটিল৷ বাংলাদেশের কোনো ডাক্তার কিছু করতে পারবে বলে ওর তেমন কিছু মনে হল না৷ কি করা যায় ভেবে ও ঠিক করল যে করেই হোক অস্ট্রেলিয়াতে ফোন দিতে হবে৷ ওর পরিচিত এক ডক্টর আছে ওকে বল্লে বই টই ঘেঁটে কিছু একটা বের করতে পারবে৷ ঢাকায় গেলে ও হয় তবে ঘুমের উপর অত সুনির্দিষ্ট বই কি পাওয়া যাবে? উহু, তার চেয়ে ভাল বোধয় ইন্ডিয়া গেলে৷ কি করবে বুঝতে পারছে না অকিল৷ পুরো গ্রামে একটা চাপা ভয় দেখা যাচ্ছে৷ কিছু কিছু মানুষ কে দেখা গেল কানা ঘুষা ও করতে৷ রীতি কে গ্রাম থেকে বের করে দেয়ার জন্যেও কিছু লোক চেষ্টা চালাচ্ছে মনে হল৷

সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর জাবেদ সাহেব এলেন৷ উনি বিশেষ খুশি বলে মনে হলো না অকিল এর৷ ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক৷ এমন না যে অকিল কোনো ডাক্তার৷ সাংবাদিকতায় পড়া লেখা করে নিশ্চয় একজন আড়াই মাস ধরে কেন ঘুমাচ্ছে আর কেন এমন আচরণ করছে তা বলতে পারবে না৷ তবে অকিল এর নিজের প্রতি এতটুকু বিশ্বাস আছে যে ওর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এই গ্রামে যে কারো থেকে বেশি হবে৷

‘ভাই আমি জানি আপনার আমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা বা ধৈর্য কোনো টাই নাই৷ কিন্তু আমি এতটুকু বলতে পারি আপনি এখন যে সাগরে আছেন তার কূল কিনারা না করতে পারলে ও কিছু টা আশা দিতে পারি৷ আমার কিছু জিনিস জানা খুব প্রয়োজন, আপনি যদি রাজি থাকেন আমি প্রশ্ন করব’

‘জী বলেন’

‘প্রথমেই আপনাকে বলি, আপনি খুব খুব গভীর ভাবে চিন্তা করে আমাকে উত্তর গুলো দিবেন, একদম বুঝে শুনে আপনার অপ্রিয় উত্তর হলেও আপনার সঠিক এবং সুচিন্তিত উত্তর আমার চাই৷ প্রথম যেদিন রীতির এমন হল সেদিন কি হয়েছিল৷’

‘ওর মা যেদিন মারা গেল সেদিন দুপুরে ওর কান্না না থামাতে পেরে আমি ওকে একটা চড় দেই৷ ও কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যায়৷ তার পর তো আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন৷’

‘জী, আচ্ছা গত দেড় মাস আগে যে মেয়েটা আবার এমন ঘুমিয়ে পড়ল সেদিন ও কি আপনি ওকে মেরেছিলেন?’

‘জী না ভাই, তবে আমি তাকে বকা দিয়েছিলাম৷ আপনি নিশ্চয় জানেন সে প্রায়ই আবোল তাবোল বকে৷ যেমন প্রায়ই বলে মা কে এনে দাও, মা ভুতের গালে৷ অনেক দিন তো হলো বলেন! আর কত সহ্য করা যায়? মানুষের কি কেউ মরে না? তাই বলে এমন করতে হবে ?’

‘এমন বকা কি আপনি তাকে প্রায়ই দেন?’

কথা টা শুনে বেশ বিরক্ত হলেন জাবেদ সাহেব৷ উত্তর দিলেন

‘জী প্রায়ই দেই’

উত্তর টা জী না হলে অকিলের জন্য খুব ভাল হত৷ কিন্তু অকিলের কিছু করার নেই৷ দুনিয়ার নিয়ম ই হচ্ছে সব কিছু কঠিন করা৷ আপনি যদি একটা ব্যাগ থেকে একটা পেন্সিল নিতে চান  আর সেই ব্যাগ এ যদি তিন টা পেন্সিল থাকে তাহলে আপনি যেই পেন্সিল টা চাচ্ছেন সেটাই সবার পরে উঠবে৷ এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু কেন এমন হয় ? ব্যাপার টা নিয়ে অনেক ভেবেছে অকিল৷ এখনো কোনো কূল কিনারা করতে পারে নি ও৷

আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বকা দেয়ার সাখে এই গভীর ঘুমের সংযোগ আছে, আবার তার বিরুদ্ধে ও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে৷ ব্যাপার টা ভাবিয়ে তুল্ল অকিল কে৷ পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল অকিল, ওর পা দুটো বেশ দ্রুত দুলছে, যখন ও অনেক বেশি চিন্তা করে তখন ওর এটা হয়

‘আপনার কি মনে হয় জাবেদ সাহেব আপনার মেয়েকে জীনে ধরেছে?’

‘আমি জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না, আল্লাহ্‌ এর মাল সে যদি এখন তাকে নিয়ে ও যায় আমার আর কিছু বলার নাই’

একটা বাবা তার মেয়ের মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও নিস্তার চায় ব্যাপার টা এই পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে খুব দুঃখজনক  মনে মনে ভাবল অকিল৷

‘আপনার স্ত্রী সম্পর্কে বলুন। তার সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?’

‘কেমন ছিল বলতে?  কি বলতে চাইছেন?’

‘আমি শুনেছি আপনার স্ত্রী যেদিন মারা যায় সেদিন ও আপনারা ঝগড়া করেছিলেন, আমি জানতে চাচ্ছি এরকম কি প্রায় এ হতো?’

‘ছোট খাটো ঝগড়া সব সময় লেগে থাকতো সেটা বলতে পারেন। সেটা তো সব ঘরেই হয়।’

‘আপনি কি বলবেন যেদিন উনি মারা গেল সেদিন সাধারণ থেকে ঝগড়ার মাত্রা বেশি ছিল?’

‘জী না’

‘আপনি ভেবে বলছেন তো?’

‘জী’

লোকটার কথায় ভরসা পেলো না অকিল। আবার প্রশ্ন করল

‘আপনার প্রয়াত স্ত্রী এর বাবা বাড়ি কোথায়?’

‘অষ্টগ্রাম’

‘আচ্ছা জাবেদ সাহেব আপনার বউ কি কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করতেন?’

‘জী না, তবে ঘুমের মাঝে মাঝে মধ্যে চিৎকার করত।’

‘সব সময় মন খারাপ বা উদাসীন থাকতো?’

‘উদাসীন এর কথা বলতে পারব না, আমি ঘরে এসে সব সময় দেখতাম সে রান্না করে রেখেছে, টাকা পয়সা এর ভালো হিসাব ছিল, বাসা বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকত, আমার বাবা মা এর ভীষণ সেবা করতো, আমার মেয়ের খুব ভালো যত্ন নিতো। সুতরাং উদাসীন ছিল বলে যাবে না। তবে তার মন প্রায় ই খারাপ থাকতো। হটাৎ হটাৎ রেগে যেতো।

অকিল মনে মনে ঠিক করল উনার বউ এর বাড়ী যাওয়া টা জরুরী এবং কাল ই যাবে বলে ঠিক করল। জাবেদ সাহেব ক্লান্ত তিনি চলে গেলেন৷ অকিল ঠিক করল আজকে সারা রাত ও মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণে রাখবে৷ সাথে করে কিছু জিনিস নিয়ে এসেছে অকিল৷ একটা রেকর্ডার,  সাথে বেশ কয়েকটা ব্ল্যাংক টেপ৷ অকিলকে একা থাকতে দিতে রাজি নয় সাগর৷ রীতিমত ভয় পাচ্ছে ও৷ নয় বছরের একটা মেয়ে পুরো গ্রাম শুদ্ধ মানুষ তাকে ভয় পাচ্ছে ব্যাপার টা একই সাথে খুব উদ্ভট আর কষ্টের মনে হল অকিল এর৷

গ্রামের বাড়িতে রাত ১০ টা অনেক রাত, অকিলের সাথে রীতির রুমেই বসে আছে সাগর৷ রীতির জন্যে আলাদা একটা রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ সাধারণত নিয়ম করে রুমে এক-দু জন মানুষ থাকে৷  চোখ দুটো বড় বড় করে একটা উপন্যাস পড়ছে সাগর৷ পায়চারি করলে ওর মাথা ভাল কাজ করে, অকিল তাই রুমে পায়চারি করছে৷ আর একটু পরপর রীতির পালস চেক করছে, মিনিটে কয়বার শ্বাস নিচ্ছে তা ও দেখছে৷ রাত ১২ টা পর্যন্ত তেমন কিছু হলো না৷  ১২ টার পর হঠাৎ দেখা গেল রীতি একটু নড়া চড়া করছে৷ সাগর ও খেয়াল করল বেপার টা৷ বইটা পাশের চেয়ার এর হাতলে রেখে উঠে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো ও৷

‘বন্ধু জেগে উঠবে নাকি? নাকি ঘুমের মাঝে সব কিছু খাওয়া শুরু করবে ? ভয় লাগছে বন্ধু কি করব?’

‘পর্যবেক্ষেন বন্ধু এই মূহুর্তটির জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম৷’

‘বন্ধু মানুষজন ডাকব?’

সাগরের কথা শুনল, নাকি পাত্তা দিল না অকিল, বোঝা গেল না৷  রীতির হাত ধরে ওর পালস দেখছে অকিল৷ মেয়েটার নড়াচড়া বাড়ছে৷ একটা গোঙ্গানির শব্দ আসছে ওর গলা দিয়ে৷ অ অ প্রথমে চিকন তার পর সেটা  মোটা হচ্ছে৷ এভাবে মিনিট তিনেক চল্ল৷ একটু পর খেয়াল করল গোঙ্গানোর শব্দ বদলে গেছে মেয়েটার৷ রীতি পায়জমা এর নিচে হাত ঢুকিয়ে দিল৷ এবার মুখের ভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল রীতির৷ কোমল-মতি ৯ বছরের বাচ্চাটাকে এখন একজন পূর্ণ বয়স্ক যুবতী মনে হচ্ছে৷ রীতির মুখে আস্তে আস্তে হাসি ফুটে উঠল৷ চোখ দুটো এখনো বন্ধ আছে৷  আস্তে আস্তে হাত টা নিচে নেমে যাচ্ছে৷ পরিস্থিতি দেখে সাগর বা অকিল কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না৷ দুজনই লজ্জায় পড়ে গেছে৷ রীতির হাত টা পায়জামার ভেতর চলে গেল এবার মুখের ভাষা আরো পরিবর্তন হল৷ হাসিটা এবার কঠোর হচ্ছে৷ ঠোট দুটো ফাকা হয়ে গেছে৷ যেভাবে হঠাৎ শুরু হয়েছিল সব কিছু সেভাবেই থেমে গেল সব কিছু৷ নিস্তব্ধ নীরবতা৷ গোঙ্গানি টা এখন আর নেই৷ সাগর কে টান দিয়ে একটু দূরে এল অকিল৷ কিছুক্ষণের মাঝে দেখল মেয়েটা উঠে বসছে৷ তার চোখ আধো খোলা আধো বন্ধ৷ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা ঘুমাচ্ছে৷ একটা তন্দ্রার একটা আবেশের মাঝে আছে৷ সেভাবেই উঠে দাঁড়াল রীতি৷ উঠে বেশ অনেক্ষন দাড়িয়ে থাকলো৷ যে কেউ দেখলে ভাববে যেন একটা মূর্তি৷ এক দন্ড নড়লো না৷ ঘাড় টা ডান দিকে একটু হেলে আছে৷  এভাবে প্রায় মিনিট বিশেক কেটে গেল৷ তারপর  ধীরে ধীরে দরজার দিকে আগাল রীতি৷ সাগর কে ইশারায় কিছু না করতে বল্ল অকিল৷ হাটতে হাটতে যেয়ে দরজার সাথে ধাক্কা খেল রীতি৷ একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল মেয়েটা৷ তার পর একটু পিছিয়ে আবার আগাতে গেল, দরজায় রীতি আবার বাড়ি খেল৷ মেয়েটা এবার আবার পেছাল আবার আগাল ফলাফল একই৷ এবার হাত দুটো  উপরে তুলে ফেল্ল রীতি৷ আস্তে আস্তে মাটিতে বসে পড়ল৷ বসে হঠাৎ হিংস্র পশুর মত দরজা কামড়ে ধরা চেষ্টা করল৷ পারল না৷ এর পর নিচু হয়ে গেল৷ কাচা মাটির ঘড়ের মেঝেতে বড় বড় থাবা দিয়ে শুরু করল মেয়েটা খুবলে মাটি তুলে খাওয়া শুরু করেছে মেয়েটা৷

ঘটনাটা দেখে সাগরের পা দুটো কাঁপছে রীতিমত৷ অকিল সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখল সাগর দু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আছে৷ ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে৷ অকিলের দিকে চোখা-চোখি হতেই সাগরের চোখে পরিষ্কার ভয় লক্ষ করল অকিল৷ ওর নিজের ও যে খুব একটা সুবিধের  ঠেকছে পরিস্থিতি তা নয়৷ আর বসে থাকা যায় না৷ পাশেই টেবিলে এক ডজন কলা আর এক ঝুড়ি গুঁড়ের পিঠা৷ অকিল খুব ধীর গতিতে সেগুলো নিয়ে এল৷ আসতে আসতে একটা কলা ছুলে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিল৷ মেয়েটা লক্ষ করল না৷ অকিল বুঝতে পারল ও ভুল করছে ঘুমে মানুষ দেখে না কিছু৷ ও একটা কলা ছুলে মেয়েটার হাতে গুজে দেয়ার চেষ্টা করল৷ কলাটা মাটিতে পড়ে গেল কি করবে বুঝতে পরছে না ও৷ পরে যেখানের মাটি খুবলে তুলছিল মেয়েটা সেখানে  পিঠার ঝুড়িটা রেখে দিল৷ এতে কাজ হল, মেয়েটা গোগ্রাসে পিঠা গুলো মুখে ঠেসে ধরছে৷ মুখ ভর্তি পিঠা গিলতে পারছেনা মেয়েটা তবু যেতে যেতে ঢোকাচ্ছে মুখে৷ আঙ্গুল দিয়ে  মানুষ কে ডাকতে ইশারা করল অকিল৷ সাগর খুব সন্তর্পণে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল৷ অকিলের খালা, দাদা আর বাবা কে নিয়ে এল সাগর৷  এক ঝুড়ি পিঠা ১০ মিনিটে নিজের চোখে শেষ হয়ে যেতে দেখল অকিল৷ মেয়েটার বয়স মাত্র নয় বছর এত গুলো পিঠা সামলাতে পারবে কিনা ভাবছে অকিল৷ পিঠা গুলো শেষ হওয়ার সাথে সাথে মেয়েটাকে পেছন থেকে ধরে বিছানার দিকে নিয়ে যেতে ইঙ্গিত দিল অকিল৷ রীতির খালা সেই চেষ্টা করে পারলেন না৷ মেয়েটা এখন অনেক জোরে জোরে চিৎকার করছে৷

‘মমিন, তোরে ছাড়ব না৷ তোকে ছাড়ব না মমিন্নার বাচ্চা৷ আমার মা কে ফেরত দে কুত্তার বাচ্চা৷

রীতির খালা পারলেন না৷ শেষে ওর বাবা ওকে পেছন থেকে ধরে ফেল্ল ওর দাদা ওর দুই পা ধরে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল৷ ওদিকে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে আরো কয়েক জন মহিলা উঠে এলো৷ ওদেকি অকিল দেখল সাগর দুয়া দুরুজ পড়া শুরু করেছে৷ রীতির দাদা ও তাই  শুরু করল৷ রীতির খালা ধরতে যেয়ে ঘুষি খেয়েছে তার ঠোট কেটে রক্ত পড়ছে৷ অনেক্ষন ধরে রাখায় আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসল। অকিল জগ থেকে পানি নিয়ে রীতি এর মুখে শুয়ে থাকা অবস্থায় ই ঢেলে দিলো অনেক তৃষ্ণার্ত মানুষের মতো টানা তিন দুই গ্লাস পানি খেয়ে গেলো। দিলে হয়তো আরো খেত, কিন্তু অকিল আর দিলো না।

ছয়

সেদিন রাতের পর সোজা জাবেদ সাহেবের বউ এর বাড়ি হয়ে ঢাকায় চলে এলো অকিল। জাবেদ সাহেবের স্ত্রী এর নাম রিশিতা।  রিশিতা দের বাড়ি খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হলো। ঐ নামে রিশিতা কে খুব কম মানুষ জানে বলে মনে হল। নিশ্চয় অন্য কোনো ডাক নাম আছে এটা প্রথমে ভাবলেও পরে রিশিতার ভাই জানালেন ওর নাম রিশিতা বেগম।  আর কোনো ডাক নাম নাই। তাহলে মানুষ কেন তাকে ঐ নামে চিনে না বোঝা গেলো না। ঢাকার পল্টনে একটা হোটেলে উঠেছে অকিল। কিছু জিনিষ এর লিস্ট করে ফেললো ও ভুলে যাবার আগেই। রিশিতা রা এক ভাই এক বোন। ওদের বয়স এর পার্থক্য দুই বছর, ভাই তা বড়। রিশিতার ছবিতে তাকে খুব ডিপ্রেস দেখাচ্ছে (নোট: ছবিতে অন্তত আমরা হাসি খুশি থাকি, তার মানে এটা বলাই যায় রিশিতার চূড়ান্ত রকম ডিপ্রেশন ছিল)   অকিল এর এই যুক্তি তার ভাই ও সমর্থন দিল। রিশিতার বাবা মা কেউ বেঁচে নেই, বিয়ের দুই বছরের মাজে দুই জন এ মারা যান। রিশিতার বংশে মানুষিক সমস্যা বা জিনে ভুতে ধরার কোনো রেকর্ড পাওয়া গেলো না। রিশিতার বাবার বংশে ও এমন কোনো রেকর্ড পাওয়া যায় নাই। ছোটবেলায় রিশিতা অনেক বই পড়তো। সাধারণত সব বাংলা উপন্যাস যেমন রবীন্দ্রনাথ, হুমায়ুন আহমেদ, সমরেশ, সত্যজিৎ এগুলা। বেশ কিছু ইংরেজি বই ও পাওয়া গেল, বেপারটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগল অকিলের কাছে।  এই অজ-পাড়া গা যে জেন অস্টিন, শেক্সপিয়ার, শার্লক এর ইংরেজি অরিজিনাল বই পাবে কখনো ভাবেনি অকিল। এমন কি ডাক্তারি বিদ্যার কিছু বই ও পেয়েছে অকিল। সব গুলোই  আসল বই এবং অনেক পুরানো বই।  বেশ অবাক হলো অকিল, ওর ভাই কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল উনার বাবা ইংরেজি এর শিক্ষক ছিলেন, পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া বেশ সম্পত্তি থাকায় ওদের আর্থিক অবস্থা ভালোই ছিলো । মেয়েকে উনি পড়ালেখার জন্যে দার্জিলিং পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ওখানে আর পড়া লেখা করা হয়নি ওর৷ দুই বছর পর ওর বোন চলে আসে৷ পাহাড়ি এলাকা পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিল মেয়েটা৷ যদিও ওর ভাই এর মতে ব্যাথা টা কোনো গুরুতর কিছু না, শরীরে সামান্য ছাল চামড়া গিয়েছিল৷ কোনো হাড় ভাঙ্গা বা মাথায় আঘাত তেমন কিছুই না৷ এর পর দেশে থেকেই অনার্স পাস করে ওর বোন। এর পর পর এ জাবেদ সাহেবের সাথে বিয়ে হয়। বিয়েটা ওর বাবা মা এর ইচ্ছা তেই হয়। বোনের মতামত ছিল কেন জানতে চাইলে রিশিতার ভাই তেমন কিছু বলতে পারলো না। আরো একটা জিনিষ জানা গেল তা হলো রিশিতার পড়ালেখার প্রতি ঝোঁক বিশেষ করে গল্প উপন্যাস এমন কি মেডিক্যাল আর বোটানি এর বই এর উপর বেশ আগ্রহ ছিল। রিশিতার বিয়ের পরপর একবার অনেক বড় একটা ঘূর্ণিঝড়ে অনেক বই নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় তিনশো এর উপর বই ছিল। অকিল যা দেখে এসেছে তাতে বোঝা যায় প্রায় একশো এরমত বই এখন ও টিকে আছে। ডাক্তারি বই গুলির মঝে একটা ইংল্যান্ড আর একটা কলকাতার লাইব্রেরি এর সিল দেওয়া।  বই গুলোর নাম যথাক্রমে

Hallucinations or, the rational history of apparitions, visions, dreams, ecstasy, magnetism, and somnambulism লিখেছেন Brierre de Boismont, Alexandre-Jacques-François

Comprehensive Textbook of Psychiatry, II, Volume 2

লিখেছেন : Alfred M. Freedman, Harold I. Kaplan, Benjamin J. Sadock

অকিল একটা বিশাল সমস্যা হলো যেকোনো বই পড়ার আগে ভীষণ নার্ভাস লাগে আর বই গুলো যদি হয় মেডিক্যাল বই তাহলে তো কোথায় নাই। অকিল বই গুলো সযত্নে ওর ব্যাগ এ গুছিয়ে রেখে দিলো। পল্টনে দেশ এর বাইরে ফোন করা যায় এমন একটা দোকান খুঁজে বের করল অকিল, অস্ট্রেলিয়া এর সেই ডাক্তার কে পাওয়া গেল না আরো দুঃখের বিষয় সেই হাসপাতাল র এক নার্স ওর পরিচিত ছিল তাকে ও পাওয়া গেলো না। দুইজনকেই একসাথে না পাওয়া যাওয়া খুবি রহস্য জনক ঠেকলো অকিল এর কাছে। কোথায় গেছে তাদের কবে পাওয়া যাবে তা ও বুঝা গেল না। শুধু এটুকু জানা গেল যে ডাক্তার প্যারিস এ বেড়াতে গেছে। যা বুঝার বুঝে গেল অকিল। নিশ্চয় ডাক্তার বেটা সেই নার্স কে বিয়ে করে এখন মধু চন্দ্রিমা তে ব্যস্ত আছে। ওদের জন্যে অকিলের খুব ভালো লাগলেও ওর সমস্যার সমাধানের কোনো কুল কিনারা পেল না ও। ওদিকে দেশ এর নামকরা ডাক্তারদের দেখা পাচ্ছেনা ও। তাদের সময় এই নেই। অনেক কষ্টে শিষ্টে ওর সাথে এক বাঙালি থাকতো যার বাবা এখানকার এমপি। এমপি এর ছেলে কে বলে তার বাবা কে দিয়ে এক নামকরা ডাক্তার এর কাছে এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেলো।

ডাক্তার এর চেম্বারটা ধানমন্ডি আট নম্বর এ। ঢাকা শহর চেনে না অকিল। এর আগে মাত্র একবার এসেছে ও ঢাকায় তাও সেটা ছয় বছর আগে তাই ডাক্তার এর চেম্বার খুঁজে পেতে খুব কষ্ট হয়ে গেল অকিল এর।

ডাক্তার সাহেবের মাথায় ঝাঁকড়া চুল, উনি একটা পাঞ্জাবি পড়ে আছেন৷ উনাকে দেখলে মনে হয় উনার শরীর দিয়ে তেল বেয়ে পড়ছে৷ চেহারা কেমন জানি অদ্ভুত৷ চেম্বারে সেই পরিচিত ডেটল বা স্যাভলন কিছু একটা হবে তার গন্ধ৷

‘জী বলুন কি সমস্যা’

‘স্যার, সমস্যা টা আমার না, আমার এক পরিচিতের’

‘রোগী কোথায় ভেতরে নিয়ে আসুন’

‘স্যার রোগী তো ঘুমিয়ে আছে, তাই আনা যায় নি, সে গ্রামে থাকে৷’

ডাক্তারের মুখটা এবার কাল হয়ে গেল, তার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে গেল৷

‘তিনি একটা কলিংবেল টিপলেন’

ভেতর থেকে দৌরে একজন পিয়ন ঢুকল ডাক্তার এর চেম্বার এ

‘এই এটার সাথে কেউ এসেছে?’

‘স্যার জী না স্যার’

এবার অকিল এর অবাক হওয়ার পালা, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝে ও ব্যাপার টা বুঝতে পারল৷ অকিল ডাক্তার কে বল্ল

‘সার আপনে আমাকে পাগল ভাবছেন বেপারটা একদম ই নিছক ভুল বুঝাবুঝি৷ আমি যে রুগী হয়ে এখানে এসেছি সে গত দুই মাস উনিশ দিন ঘুমাচ্ছে । তাই আমি আপনাকে বলছি রুগী ঘুমচ্ছে ।’

এবার অবাক হওয়ার পারা ডাক্তার এর,  তিনি হলেন।

‘দুই মাস উনিশ দিন ধরে ঘুমাচ্ছে? আপনে আমার সাথে ফাজলামো করেন?’

কথাটা শুনে মোটেই অবাক হলো না অকিল । ডাক্তার এর চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসলো অকিল । প্রচণ্ড শীত এ  কাঁপছে ও । রাত এখন আটটা  বাজে। ঢাকার রাজ পথে  যেন বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে । কাঁপতে কাঁপতে যেয়ে একটা টং এর দোকানে  ঢুকল ওকীল ।

‘চাচা চা তো হবে না?’

‘হ বাবা কেন হবে না অবশ্যই হবে ।’

‘চাচা অদা দেন চিনি দিয়েন অল্প করে, যদি ধরেন আধা চামচ চিনি ।’

কিছুক্ষণের মাঝেই চা এল৷ অকিল এক কাঁপ চা ই অনেক্ষন ধরে খেল৷ আজ পথে ঘাটে মানুষ নেই৷ সম্ভবত প্রচন্ড শীতের কাড়নে মানুষ খুব জরুরী কিছু না হলে বের হচ্ছে না৷ অকিলের মাথায় কিছু ঢুকছে না৷ কি করা যায় কই যাওয়া যায়৷ এসব ভাবতে ভাবতে ও চা ওয়ালাকে বল্ল৷

‘চাচা আপনাকে একটা প্রশ্ন করতাম, কিন্তু যে প্রশ্ন টা করতে চাচ্ছি সেটা মানুষ কে করা অভদ্রতা, তাই আপনার কাছে অনুমতি চেয়ে নিচ্ছি৷ আপনি অনুমতি দিলে আমি জিজ্ঞেস করব’

চাচা মিয়া কিছুটা অবাক হলেন৷ জীবনে তাকে কেউ এত সম্মান করে নাই৷ তার নিজের কাছে খুব ভাল লাগল ব্যাপার টা৷ একজন মানুষ তাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবে তার জন্য অনুমতি চাইছে৷

‘বাবা নির্দ্বিধায় করতে পার’

‘চাচা আপনে সারা দিনে কত টাকা রোজগার করেন?’

চাচা বেশ অবাক হলেন এটা জিজ্ঞেস করার জন্য অনুমতি নিল?

‘বাবা দিনে প্রায় দুইশ টাকার মত রোজগার হয়৷ হেয়ানে ধর আশি টাকার মত লাভ হয়৷ এই আরকি৷’

‘চাচা আপনাকে আমি দিনে তিন শত টাকা করে দিব৷ তিন বেলা খাওয়াব৷ আপনে আগামী এক সপ্তাহ আমার সাথে থাকবেন৷ আমারে চা করে খাওয়াবেন৷ চা এর চা পাতি, চিনি আর যা লাগে সবই আমি দিব কি বলেন?’

এবার চাচা বেশ অবাক হলেন বলে কি ? এ তো পুরা চা খোর৷ উনার রাজি না হওয়া কোনো কারণ দেখলেন না৷ অকিল চাচা কে নিয়ে রওনা হলেন৷

সাত

আজ সকাল থেকে প্রথম বইটা নিয়ে বসেছে অকিল৷ বেশ ইন্টারেস্টিং বই৷ অনেক কিছুই ও বুঝতে পারছে না৷ যখন বুঝতে পারছে না মেডিকেল রিলেটেড টার্মিনলজির ডিকশনারি দেখছে৷ তিন চার রকমের ডিকশনারি নিয়ে বসেছে অকিল৷ এক একটা পাতা শেষ হতে অনেক সময় লাগছে৷ ও বুঝতে পারল এভাবে পরে গেলে হবে না৷ একটা বুদ্ধি করল ও৷ পুরো বইটা না পরে ঠিক করল দ্রুত ওয়ার্ড গুলোতে চোখ বুলিয়ে যাবে৷ কোথাও কোনো ইন্টারেস্টিং কিছু পেলে আগে পিছে পড়ে দেখবে৷ অকিল ধারনা করছে রিশিতার ও তার মেয়ের মত একই সমস্যা ছিল৷ আকিলের মতে রোগ টা বংশগত৷ আর তাই হয়তো রিশিতা বই গুলো আনিয়েছিল তার রোগ সম্পর্কে পড়ালেখা করতে৷ তবে এই বইগুলোতেই যে কিছু পাওয়া যাবে তার কোনো গ্যারান্টি নাই৷ অকিল নিজে এমন অদ্ভুত রোগের কথা শুনে নাই৷ এমন কি যে বিখ্যাত ডাক্তার এর কাছে গিয়েছিল অকিল সে পর্যন্ত কিছু জানে না এই সম্পর্কে৷ রিশিতা  এই বিষয়ে যদি কোনো বই যদি কখনো পেয়েও থাকে হয়তো ঘূর্ণি ঝড়ে সেই বই গুলো নষ্ট হয়ে গেছে৷ আবার হতে পারে এই বইগুলোতে কিছু আছে যা ওকে সাহায্য করবে৷

টানা সাত ঘণ্টায় বইটা ঘাটার  পর অকিল ভাবল আর শরীরে কুলচ্ছেন একটু বিশ্রাম খাওয়া দাওয়া দরকার৷ এদিকে চা ওয়ালা চাচা ও হাঁপিয়ে উঠেছেন, গত সাত ঘণ্টায় উনি প্রায় ৪০ কাপ চা আনিয়েছেন৷ অকিলের খুধা নাই, থাকার কথা না৷ এত চা খেলে কারো ক্ষুধা ধাকে না৷ অকিল স্নান করে আসল৷ এসে কিছুক্ষণ আজকের দিনের পত্রিকা কিছুক্ষণ ঘাটা ঘাটি করল৷  তার পর পিজি হাসপাতালের লাইব্রেরিতে কতক্ষণ সময় কাঁটালো৷ নিউরোলজি আর ঘুম রিলেটেড সমস্যার কিছু বই খুঁজে বের করল৷ সেই বই গুলো থেকে লেখকদের নাম যোগাযোগ এর ঠিকানা বের করল৷ যোগাযোগ করে পাবলিশার দের ঠিকানা পাওয়া গেল৷ দুটো পাবলিশার এর ফোন নাম্বার দেয়ে আছে৷ তাদের অকিল ফোন করে রাইটার দের চিঠি পাঠানোর ঠিকানা চেয়ে নিল৷ এক জনের টা পাওয়া গেল আরেকজনের তা দিতে অস্বীকৃতি জানাল পাবলিশার৷

হোটেলে ফিরে এসে অকিল খুব মনোযোগ দিয়ে মোট ৫ টা চিঠি লিখল৷ একই কথা সব চিঠিতে৷  পল্টনের এই হোটেলের ঠিকানায় যোগাযোগ করতে বল্ল৷ চিঠি টা নিম্নরূপ

জনাব,

প্রথমেই ধন্যবাদ আমার চিঠি পড়ার জন্য সময় বের করার জন্য৷ আমি জানি আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ তাই কাজের কথায় যাচ্ছি সরাসরি৷

আমি বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা৷ আমাদের এলাকায় একটি ৯ বছরের মেয়ে গত ২ মাস ১৯ দিন ধরে ঘুমাচ্ছে৷ সে মাঝে মধ্যে তার বাথরুম ও খাওয়াদাওয়ার  প্রয়োজনে আধো ঘুম আধো জাগা একটা অবস্থায়  পৌছায় সেই স্টেটে সে সামনে যা পায় খাওয়ার চেষ্টা করে, ঘুমের সময় তার পাল্স কমে যায়, যতক্ষণ ঘুমে থাকে সে স্বপ্ন দেখে,  আক্রমণাত্মক ব্যবহার করে, তার যৌন কামনা বেড়ে যায় এবং তা প্রকাশ করে , মেয়েটি মাঝে মধ্যে চিৎকার করে৷ গত দুই মাস উনিশ দিনের আগে আরো চার মাস আগে সে  মোট ছয় দিন এভাবে কাটায় তার পর হঠাৎ এদিন সে সম্পূর্ণ ভাল মানুষের মত আচার আচরণ করে৷ মজার বিষয় গত ছয় দিনের কোনো ঘটনা তার মনে ছিল না৷

আপনি বুঝতেই পারছেন আমাদের এখানে  ঘুম এর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই৷ তাই আমি বাধ্য হয়ে আপনার কাছে চিঠি লিখিছি আশা করছি আপনি আপনার সুচিন্তিত মতামত প্রদান করবেন৷ আপনি চাইলে আমার কাছে আপনার কনসালটেশন ফি চেয়ে পাঠাতে পারেন৷ আমি আপনার দ্রুত উত্তরের আমায় থাকব৷

অকিল

দুটো বই শেষ করতে অকিলের মোট ৯ দিন সময় লেগে গেল৷ চা ওয়ালা চাচা ২ দিন কাজ করে অকিলের কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে গেলেন৷  ৯ দিন পর যখন অকিল বইটা শেষ করে দাঁড়াল তখন ওর মাথা ঘুরছে৷ অকিলের মনে হচ্ছে ওর ওজন কম পক্ষে ৫ কেজি কমে গেছে৷ গত দুই দিনে অকিল বাথরুম ব্রেক ছাড়া আর কোনো কাড়নে উঠে নি৷ শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে ওর৷ কিছু খাওয়া দরকার৷ রুমের কলিং বেল টিপে রুম বয় কে ডেকে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে বল্ল অকিল৷ খাবার দেয়ার সময় ওর কোনো চিঠি এসেছে কিনা খোজ নেয়ার কথা বল্ল৷

রুম বয় টা চলে যাওয়ার পর অকিল ভাবল স্নান টা করে নিলে কেমন হয় এর মাঝে৷ অকিল বাথরুমের দরকার সামনে ঠিক তখন ওর মাথা টা ঘুরে উঠল৷ কঠাৎ দেখল পুরো পৃথিবী টা দুলছে৷ বাথরুমের দরজার হ্যান্ডল ধরে ব্যালেন্স করতে চাইল পারল না হঠাৎ মনে হল বাথরুম টা দূরে চলে গেল৷ তার পর খেয়াল করল ওর চোখ দুটো সাদা লাইটে ভরে গেল৷ তার পর সব হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল৷

অদিক হোটেল বয় খাবার নিতে এসে অকিল এর রুম ধাক্কা ধাক্কি করে ভাবল রুমের চাবি  এনে খাবার ভেতরে দিয়ে যাই , নিশ্চয় কোথাও গেছে চলে আসবে৷ রুমের চাবি খুলে ছেলেটা দেখল অকিল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে পুরো রুম রক্তের বন্যায় যেন ভেসে গেছে৷

জ্ঞান হারানোর ৩ দিন পর জ্ঞান ফিরল অকিলের৷ জ্ঞান ফেরার পর দেখল সাগর ওর দিকে উপুড় হয়ে তাকিয়ে আছে

‘কিরে, বেচে আছিস তাহলে!’

পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেয়ে বেশ ভাল লাগল অকিল এর৷ মলিন একটা হাসি দিল ও৷ কথা বলতে যেয়ে আবিষ্কার করল মাথায় প্রচন্ড ব্যথা কথা বলতে গেলে সেটা আরো লাগে৷

‘অত সহজে মরে যাব? তোর মেয়ের সমস্যা টা সমাধান করতে হবে না ?’

কথা টা শুনে সাগরের মুখটা কাল হয়ে গেল৷ সাগর ওর কাঁধের এদিকে ওদিকে তাকাল৷

‘বলছিস কি তুই, মানে …’

আমতা আমতা করল সাগর৷ অকিল ওর হাতটা সাগরের হাতে রেখে

‘বন্ধু ব্যাপার না, আমার হাতের স্যালাইন টা খুলে দিতে বলবি ?’

‘স্যালাইন খুলবি? মানে….’ সাগরের সক টা এখনো কাটে নি৷

অদিকে জ্ঞান ফিরেছে শুনে দু জন নার্স দৌরে এসেছে৷ অকিলের চোখে লাইট দিয়ে পরীক্ষা করল৷ একটু পর ডাক্তার এলেন৷

‘কি ভাই ব্যাপার টা কি বলেন তো? অজ্ঞান হওয়ার আগে কয় দিন না খেয়ে ছিলেন ?’

ইয়ং ডাক্তারের কথা শুনে একটু হাসল অকিল৷ মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর৷ মাথার চুল ছেলেদের মত কাটা৷ বড় চুলে ঝামেলা হয় হয়তো তাই এভাবে কাটা৷ কিন্তু বেশ লাগছে , খারাপ লাগছে না৷ দেখেতে মাঝারি গড়নের শ্যামলা৷ মেয়েটার কথার মাঝে একটু দুষ্টুমি ভাব আছে৷ হেসে হেসে কথা বলছে৷ হাসি টা বেশ৷ কাল রং এর একটা শাড়ি তার উপর সাদা এপ্রন বেশ ভালই রাগছে৷

‘ম্যডাম, কবে যেতে পাড়ব বলেন তো?’

‘ওমা সে কি, পুলিশ ভাই, আপনার বন্ধুর বোধয় আমাকে একদম পছন্দ হয় নি তাই না? যেই আমি এসে কথা বল্লাম অমনি বলে কবে যেতে পারবে৷ এই আমি কি দেখতে এত পচা নাকি ?’

মেয়েটা কথা ও বলে এত সুন্দর করে, মনে মনে ভাবল অকিল৷ মাথার ব্যথাটা এখন বেমালুম চলে গেছে, কিন্তু বুকের বাম দিকে একটা ব্যথা অনুভব করল অকিল৷ সাথে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস৷ তার কিছুক্ষণ পর অকিল ভাবল মানুষের হার্ট তো আসলে বাম দিকে থাকে না, হার্ট টা আসলে  মাঝা মাঝে একটা অবস্থানে থাকে , দুই ফুস ফুস এর মাঝে৷ তাহলে বুকের বাম দিকে কেন মানুষ বলে ? আবার বাম দিকেই কেন ব্যথা টা লাগল?  নাহ মেয়েটাকে আসলে অসম্ভব মনে ধরেছে৷

আট

অকিল কে আরো দুই দিন হাসপাতালে থাকতে হলো৷ শেষ দিন সেই ডাক্তার মেয়ে টাকে কথাও খুঁজে পেল না অকিল৷ অন্তত শেষ দেখা টা হোক আশা করেছিল সেটাও হল না৷ তাই অকিলের মন ভীষণ খারাপ, মন খারাপ করে গ্রামের বাড়ি রওনা দিল৷ মন খারাপের আরেকটা কারণ হোটেলে খোজ নিয়ে জানা গেছে ওর নামে কোনো চিঠির উত্তর আসে নি৷ ১৪ দিনে যখন কোনো উত্তর আসে নি আর আসবে না বলেই মনে হচ্ছে অকিলের৷ আর্জেন্ট চিঠি পাঠিয়েছিল যেতে সর্বোচ্চ তিন দিন লেগেছে এর বেশি নয় আসতে না হয় ১০ দিন লাগল তাও তো হয় না৷ গ্রামের বাড়ি পৌছুতে প্রায় সারাদিন ই লেগে গেল রাত ৮ টা নাগাদ পৌঁছুল অকিল৷

পরদিন ভোর বেলায় সাগর আর অকিল রওনা দিল রীতিদের গ্রামে৷ আজকে কুয়াশা নেই বল্লেই চলে৷ পানি অস্বাভাবিক রকম শান্ত৷ যেন নড়ছেই না৷ নৌকাটা তাই দোল ও খাচ্ছে না৷

‘বন্ধু তুই জানলি কি করে বল্লি না তো’

হাসপাতাল এ এই নিয়ে কথা হওয়ার পর আর কথা হয় নি অকিলের সাথে সাগরের৷ লজ্জায় হয়তো কথা টা আর তুলে নি সাগর৷

‘বন্ধু, তুই যখন জিজ্ঞেস করছিস তাই বলি, তবে জেনে রাখ আমি তোকে কোনো খারাপ চোখে দেখছি তা না৷ রীতি যে তোর মেয়ে সেটা বুঝেছি বেশ কয়েকটা কারণে৷ প্রথমে আমি বুঝেছি ওটা জাবেদ সাহেবের মেয়ে না৷ এখন প্রশ্ন হল কি করে বুঝলাম৷ এক, এদের চেহারায় মিল নেই৷ এখন কথা হল চেহারায় মিল না থাকতেই পারে এটা কোনো বড় ব্যাপার না৷ তাহলে আসি দুই নাম্বার পয়েন্ট এ৷ আমি যখন রীতির পাল্স দেখলেম তখন খেয়াল করলাম রীতির বাম হাতের কানি আঙ্গুল টা একটু বাঁকা৷ আমি যখন ওর হাত টা বিছানায় রেখে দিলাম পাল্স দেখে তখন খেয়াল করলাম জিনিস টা৷ সমতল স্থানে রাখলে জিনিস টা খেয়াল হয়৷ বাঁকা টা খুবই সামান্য তেমন কারো চোখে পড়ে না৷ আর তোকে তো আমি অনেক দিন চিনি তোর বাম হাতের কানি আঙ্গুল টা যে অমন আমি জানি৷ ’

‘কিন্তু এতেই তো প্রমাণ হয়না আমি ওর বাবা৷’

‘না না, তা তো হয় ই না, আমি আরো খেয়াল করলাম জাবেদ সাহেবের এই সমস্যা নেই৷ আমি তখন নিশ্চিত হলাম এটা উনার মেয়ে না৷ এখন তুই বলতে পারিস রিশিতার তো থাকতে পারে৷ আমি নিশ্চিত জানি রিশিতার এই সমস্যা নাই৷ ওদের বাড়ি যখন যাই আমি ওদের ফ্যামিলি ছবি দেখেছি ওর ভাই কে জিজ্ঞেস করেছি৷ এখন তুই বলবি ঠিক আছে বাচ্চা টা জাবেদ সাহেবের না কিন্তু তোর কিভাবে বুঝলাম৷ তাই তো ?’

‘হু’ বেশ চিন্তিত দেখাল সাগর কে

‘সেদিন রাতে তোর মানিব্যাগ টা পড়ে গিয়েছিল বিড়ি বের করতে যেয়ে মনে আছে?’

‘যাহ শালা এখানেই ধরা খেয়ে গেলাম৷’

‘মানিব্যাগ এর ঐ ছবিটা তো রীতির ছোটবেলার তাই না?’

‘হু’

‘রীতির ছোট বেলার একটা ছবি ওর মা এর বাড়ি যেয়ে ওদের পারিবারিক এ্যালবাম এ দেখি তার পরও সব কিছু মিলে নি৷ আমি তখনো ভাবি নি রীতি তোর মেয়ে কিন্তু এটা ভেবেছি জাবেদ সাহেবের মেয়ে না৷ বিশ্বাস করবি না যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম তখন বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন মাথায় অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল৷ আর যখন জ্ঞান ফিরল মনে হল আমি সব জানি৷ এরকম হয় ব্যাপারটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে৷ আচ্ছা ছবিটা কি রিশতাই দিয়েছিল?’

‘হু, অনেক চেয়ে টেয়ে আমি ঐ ছবিটা আদায় করেছিলাম রিশিতার কাছ থেকে, ওকে আমি খুব ভালবাসতাম জানিস? বাবা মা এর কথা রাখতে যেয়ে ও জাবেদ কে বিয়ে করে৷ রিশিতা আমার চেয়ে বয়সে ৪-৫ বছরের বড় হবে৷ তাই ওর বাবা মা বিয়েটাতে রাজি হয় নি৷’

‘তোদের ব্যাপার টা জানত তারা?’

‘হু’

‘রীতি এর ব্যাপার টা জানত?’

‘নাহ’

রীতিদের বাড়ি পৌছুতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল৷ গ্রামে পাড়া দিতেই এক বৃদ্ধ চাচা দৌড়ে এলেন৷

‘বাবা জীনের আসর ছাড়সে, জীনের আছড় ছাড়সে, তোমারে খুজতেসে, যাও যাও জলদি যাও’

ব্যাপার টা বেশ অবাক লাগল অকিলের৷ অকিলকে চেনার কথা না মেয়েটার৷ ঘুমের মাঝে ওকে দেখা বা নাম জানার কারণ নাই কোনো৷ এবং যদ্দুর ও বুঝতে পারছে ঘুমিয়ে থাকার সময় করা কিছু মেয়েটার মনে থাকে না৷

রীতি দের বাসার সামনে অনেক ভীর৷ অকিল আস সাগর সেই ঘড়ে ঢুকল৷ রীতি বসে আছে৷ সে একটা নতুন একটা জামা পড়েছে৷ সেটা সবাই দেখাচ্ছে৷ অকিল কে দেখে মেয়েটা চুপ হয়ে গেল৷

‘মা, তুমি আমাকে খুঁজেছ?’

আশে পাশের মানুষের দিকে তাকাল মেয়েটা, যেন বলতে চাইছে না কথা এত গুলো মানুষের সামনে৷ বুঝতে পারল ব্যাপার টা অকিল৷

‘মা চল আমরা ঘাট থেকে একটু ঘুরে আসি, অনেক দিন বাড়ি থেকে বের হও না৷ ভাল লাগবে৷’

রীতির হাত ধরে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাটছে ও আর অকিল৷ আজ বেশ রোদ একটু হাটতেই ঘেমে উঠল অকিল৷ ও চাইছে মেয়েটা কথা বলতে, শুরু করুক কিছু নিজে থেকে বলতে চাইছে না৷ অনেক দূর হাটার পর মেয়েটা এদিক ওদিক তাকাল৷ যেন বোঝার চেষ্টা করল কেউ শুনছে কিনা ওদের৷ যখন নিশ্চিত হল তখন অকিলের দিকে তাকিয়ে ওকে কাছে আসতে বল্ল রীতি৷ অকিল  হাটু ভাজ করে নিচু হল৷ রীতি ফিস ফিস করে অকিল কে বল্ল

‘আমার মা কে এনে দিবেন?’

অকিলের বুকে মোচর দিয়ে উঠল৷ এতটুকু মেয়ে এত দখলের পর শুধু মা কে চাইছে৷  তার আর কোনো চাওয়া নেই৷ চোখ দুটো টল মল করে উঠল অকিলের৷

‘মা, তোমার মা তো অনেক দূরের দেশে চলে গেছে৷ আমরা চাইলেও যোগাযোগ করতে পারব না৷ কিভাবে আনি বল?’

‘মা ঢাকায়, ভুতের গালে৷ ঐ যে মোমিন টা আছে না? ও ভাল না৷ মোমিন টা মা কে নিয়ে গেছে৷’

‘ভূতের গালে কি মা?’

‘ভুতের গালে, আরে আপনি বুঝেন না বুঝি৷ আপনি তো ঢাকা থেকে আসলেন একটু আগে৷’

অকিল বেশ অবাক হল

‘তুমি জান? বাবা বলেছে বুঝি?’

‘না আমি জানি কেউ বলে নি, বাবা তো আপনার কাছে ছিল৷’

এবার বেশ ধাক্কা খেল অকিল৷ সাগরের কেমন লেগেছিল এটা বলার পর ও এখন বুঝতে পারছে৷ মনে মনে ভাবল অকিল

‘বলে কি! সাগর যে ওর বাবা এটা জানে মেয়ে টা ? নাকি ওর জাবেদ সাহেব ঢাকায় গিয়েছিল?’

‘মা তোমার বাবা তো এখানেই ছিল, তোমাকে দেখা শোনা করল’

কথা টা শুনে মেয়েটা তাচ্ছিল্যের সূরে বল্ল

‘আপনার চিঠি গুলো আসবে না৷ ওদের অত টাইম নেই’

অকিলের মাথা টা ঘুরে উঠল এবার, মাই গড৷ মেয়েটা এসব কি করে জানে ? কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না ও৷

‘আপনি চাইলে আমাকে আমার মা কে এনে দিতে পারেন৷ আমার আর কারো কাছে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই৷’

কি করবে কিছু বুঝতে পারল না অকিল৷ ওর নিজের ই এখন এই দিনে দুপুরে ভয় ভয় লাগতে শুরু করল৷ মেয়েটা কিভাবে এগুলা জানল৷ অকিল মেয়েটাকে নিয়ে দ্রুত গ্রামে চলে গেল৷ পরে সাগর আর ওর বাবা কে জিজ্ঞেস করল কেউ মেয়েটাকে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলেছে কিনা, জানা গেল ও যে ঢাকায় গেছে মেয়েটাকে বলা হয় নি , চিঠির কথা শুধু সাগর জানত, সাগর ওর সাথেই এসেছে সুতরাং বল্লে অকিল জানত৷ এবং জাবেদ সাহেব ঢাকায় গিয়েছিলেন কিনা এটা ও জিজ্ঞেস করতে ভুল্ল না অকিল৷ কিন্তু তিনি যান নি৷ মেয়েটাকে কি কখনো সাগর বলেছিল যে সাগর ওর বাবা? এমন প্রশ্ন করে সেটার ও উত্তর পাওয়া গেল নেগেটিভ৷ অকিলের মাথা ঘুরছে৷ কি ভাবে জানে মেয়ে টা৷

অকিল ঠিক করল একটা মারাত্মক কাজ করতে হবে৷ আগে যেতে হবে মিঠামইন সদর এ৷ প্রায় পাঁচ ঘণ্টার পথ৷ অকিল বল্ল মেয়েটাকে নিয়েই চলুন খুব দ্রুত যা করার করতে হবে৷ ওরা রওনা দিল মিঠামইন এর দিকে  ওর সাথে আছে জাবেদ সাহেব, সাগর, রীতি, রীতির বাবা আরো গ্রামের কিছু মুরুব্বি৷

নয়

সকাল ৯ টা বাজে৷ মিঠামইন সদরের দোকান-পাট গুলো খুলতে শুরু করেছে৷ সাগর ঢাকার রমনা থানায় একটা ফোন দিয়ে কিছু ইষ্ট্রাকশন দিল৷ আর অকিল ফোন দিল ওর বন্ধু বাবা এমপি সাহেব কে৷ এমপি সাহেব মাই ডিয়ার মানুষ৷ ছেলের বন্ধু হওয়ায় আবারো কদর করলেন এবং জানালেন কোনো সমস্যা না কাজ টা হয়ে যাবে৷ তবে উনার কথায় অকিল খুব একটা ভরসা পেল না৷ কত মানুষ কে এরা এমন কত কথা দেয় কত গুলো কথা রাখে সেটাই একটা বড় বিষয়৷

‘বাবা কাজ টা কি ঠিক হবে?’ জিজ্ঞেস করল রীতির দাদা

‘চাচা কখনো কখনো অপ্রীতিকর কাজ টা করতে হয়৷ অপ্রীতিকর কাজ টা না করলে যখন নয় তখন তা আর দেরি করি লাভ নেই৷’

মিঠামইন গোরস্থান টা হাওরের পাশেই৷ গ্রামের কিছু মুরুব্বি আর জাবেদ সাহেব মিলে রিশিতার কবর টা বের করা হল৷ সামনে রিশিতা এর নাম ফল টি লাগানো৷ অকিল বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল আপনারা নিশ্চিত তো এটাই ? নাম ফল ও তাদের স্মৃতি তাই বলে৷ কবরস্থান এর খাতায় তো তাই লেখা দক্ষিণ পশ্চিম  দিকে শেষ আইল থেকে ৩ নাম্বার আইলের ৯ নাম্বার কবর রিশিতার৷ সব ই মিলে যায়৷ জাবেদ সাহেব অনুমতি দিলেন৷ কবর খোঁড়া  শুরু হল৷ সবার মাঝে চাপা গুঞ্জন৷ সাগর তার পুলিশ ড্রেস পরা৷ সে মোটা মোটি অফিসিয়াল ভাবেই অনুমতি ম্যানেজ করেছে৷ যদিও অনুমতি পাওয়াটা বেশ কষ্ট সাধ্য কিন্তু সে ম্যানেজ করেছে৷

কবর টা খোঁড়া হচ্ছে৷ আস্তে আস্তে সাবল গুলো মাটির গভীরে যাচ্ছে৷ এক সময় সাদা কাফনের কাপড়ের এক কোনা বেরিয়ে আসতে দেখা গেল৷ আশে পাশে জড় হওয়া মানুষের মাঝে একটা গুঞ্জন দেখা গেল৷ আরো খোঁড়া হল এবার পুরো কাপড় টা বেরিয়ে এল কিন্তু  কোনো লাশ  পাওয়া গেল না৷ এমন কি যদি ধরেও নেয়া হয় শরীরে পচে গেছে কীট পতঙ্গ খেয়ে নিয়েছে  কিন্তু হাড় গোড় তো সেই কাপড়ের ভেতর থাকবে ? কিচ্ছু নেই৷

সবার মাঝে একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ করল অকিল৷ সাগর কে ও বল্ল

এখানকার লোক জন কে এদিকে নিয়ে আয় আমার কথা আছে৷

‘স্যার স্যার, কি কান্ড বলেন দেখি এত বছর কাজ করি এই কবরস্থানে এমন জীবনেও শুনি নি’

‘শুনেন নি নাকি লাশ বেঁচে দিয়েছেন’

‘আসতাগফিরুল্লাহ স্যার৷ আমার আল্লাহ্‌ এর ভয় আছে আমর নিজেকে ও একদিন মরতে হবে৷ এই কবরস্থানে আমার দাফন হবে৷ এটাই আমার বাড়ি এটাই আমার ঘড়৷ আমি এই কাজ আজ করলে আমার সাথেও হবে৷’

কথা গুলো বলে লোকটা কন্নায় ভেঙ্গে পড়ল৷

‘যেদিন রাতে কবর দেয়া হল সেদিন আপনি ছিলেন এখানে?’ জিজ্ঞেস করল সাগর

‘স্যার আমি ঈদের দিনেও এখানেই থাকি আমার ঘরবাড়ি নাই পরিবার নাই’

‘কোনো কিছু হয়েছিল কবর টায়? বলতে পারেন কিছু’

‘স্যার তখন তেমন কিছু মনে হয় নাই কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপার টা গুরুতর৷ উনাকে কবর টা দেয়া হয় ভোর চার টার দিকে৷ আমি যখন সকালে এলাম কবর টা ঠিক ঠাক দেয়া হয়েছে কিনা দেখলাম মাটি ঠিক মত চাপা দেয়া হয় নাই৷ এবড়ো থেবড়ো হয়ে আছে৷ উঁচা নিচা৷ আমি আবার যারা কবর এ কাজ করেছিল তাদের ডেকে এনে বকে ঠিক করিয়েছি৷’

‘যারা কাজ করেছিল আছে কেউ?’

‘জী জী’

দুজন লোক কে ধরে নিয়ে আসা হল৷ তাদের কথা মত জানা গেল তার প্রথম বার ই ঠিক মতই দিয়েছিল৷ এতে তাদের কোনো সন্দেহ নেই৷ তবে সেদিন রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল, সেজন্যে হয়তো এটা হতে পার৷ এদিকে কবর টা আবার হাওরের পাশে এদিকে প্রায় ই জমি ধ্বসে পড়ে৷ বেশ কিছু কবর সহ মাটি ভেঙ্গে নিয়ে গেছে স্রোতে৷  অকিল মনে মনে ভাবল৷ ব্যাপাটা ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে৷ লাশ টা একে পাওয়া যায় নি৷ পাওয়া গেলে সব সমস্যার একটা উত্তর এতো৷ এখন আবার জানা যাচ্ছে কেউ হয়তো কবর দেয়ার পর তা কেউ খুঁড়েছে অথবা ন্যাচারাল কারণেও ডিস্টার্ব হতে পারে৷

কাজ গুলো করতে করতে দুপুর হয়ে গেল৷ রীতি কিছু খাবে না৷ কোনো একটি কিছু হচ্ছে সে বুঝতে পেরেছে৷ অকিল তার সাথে কথা বলতে গেল

‘তুমি সব কিছু বুঝ তাই তোমাকে সত্যি কথা টাই বলছি৷ তোমার মা কে কবরে পাওয়া যায় নি৷’

অকিলের কথা শুনে রীতি একাট হাসি দিল৷

‘আপনাকে তো বলেছি মা ঢাকায়৷ মমিনের কাছে৷ বিশ্বাস হলো?’

‘মমিন কোথায় থাকে তুমি আমাকে বলবে?’

‘ঢাকায় থাকে, ভুতের গালে’

‘ভুতের গাল কি কোনো যায়গার নাম?’

‘হু’

‘তুমি যায়গাটা চেন?’

‘বাহ, আমি ছোটো মানুষ না? ছোট মানুষরা কি এগুলো চিনে?’

‘মমিন কে দেখলে তুমি চিনবে?’

কথাটার কোনো উত্তর দিল না রীতি, কেন দিল না বুঝতে পারছে না ও৷ রহস্য করছে কেন মেয়ে টা ?

‘মমিন কি কোনো খারাপ লোক?’

এবার মাথা নেড়ে উত্তর দিল রীতি

‘না’

‘আমরা তাহলে বিকেলেই ঢাকা রওনা দেই কি বল ? মা কে খুঁজে বের করতে হবে তো না?’

মেয়েটার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল৷ কিন্তু কি যেন আরো বলতে চায় মেয়েটার চোখ দেখে তাই মনে হচ্ছে৷

‘আরো কিছু বলবে৷’

‘মমিনের বাড়ি টা অনেক বড়, অনেক৷’

‘বাড়ি টা তুমি দেখেছ?’

‘হু’

‘দেখতে কেমন আমাকে বলবে’

‘সাদা বাড়ি, অনেক বড় অনেক

‘পাশ দিয়ে বড় নাকি লম্বা?’

‘পাশ দিয়ে’

‘কয় তালা বাড়ি মা বলতে পার?’

‘মনে করতে পারছি না’

‘আশে পাশে কি আছে বলতে পার?’

‘একটা পুকুর আছে, একটা দোলনা আছে, মা দোলনায় বসে আমার কথা ভাবে৷’

‘আর কিছু বলতে পারবে ?’

‘না, আমার অসুস্থ লাগছে আপনি যান৷ আমার খুব ক্লান্ত লাগছে’

ঢাকায় আরেকটা ফোন দিল সাগর৷ বিকাল চার টার দিকে ওরা ঢাকায় রওনা দিল৷

দশ

ঢাকায় এসেছে ওরা প্রায় ১ দিন৷ অকিল দিনে রাতে একটা সাদা বাড়ি খুঁজছে৷ রমনা থানায় যেয়ে অসির সাথে কথা বলেছে৷ সব ঘটনা খুলে বলতে অসি বল্ল

‘আমি আমার জীবনে এত অদ্ভুত ঘটনা শুনি নি৷ নিশ্চয় এই মেয়ের সাথে কোনো ভাল জীন আছে৷ জীন টা মেয়েটাকে সাহায্য করছে৷ কথাটা বলে একটা অট্ট হাসি দিলেন অসি৷ পরে অবশ্য সাথে সাথে থামিয়ে দিলেন৷ তবে আসার পথে তিনি কথা দিলেন তার সাধ্য মত চেষ্টা করবেন৷ অদিকে চা ওয়ালা সাদেক কে ও খুঁজে পাওয়া গেল না তার আগের যায়গায়৷ সাদেক কে দরকার ছিল অকিলের৷ আবার ঢাকায় আসলে দেখা করে যাবে আর কিছু টাকা দিবে ওর মেয়েটার পড়ালেখার জন্যে কথা দিয়েছিল অকিল৷

সেদিন সন্ধ্যার কথা হঠাৎ হোটেলের দরজা নক করছে কেউ৷ সারাদিন পরিশ্রমের পড় স্নান করার জন্যে শুধু রেডি হচ্ছিল অকিল দরজা খুরে দেখল পুলিশের একজন কষ্টেবল দাড়িয়ে আছে৷

‘স্যার, স্যার আপনাকে এখুনি থানায় যেতে বলেছে’

‘স্নান টাই যে করি নাই মশাই, একটু বসুন? আমি স্নান টা করে আসি?’

‘স্যার দ্রুত করবেন দয়া করে আমাদের জরুরী একটা কাজ আছে৷ বুঝেন ই তো দেশের পরিস্থিতি ভাল না৷’

দেশের রাজনৈতিক অবস্থা আসলেই ভাল না৷ অকিল দেরি করবে না কথা দিল৷ থানায় পৌছুতে পৌছুতে প্রায় রাত সাড়ে সাত টা বেজে গেল৷

‘অকিল সাহেব আসুন আসুন, সাগর সাহেব বসেন৷ গুড নিউজ আপনার ঐ বাড়িটা পেয়েছি মনে হয়৷’

‘বলেন কি!’ উত্তেজিত হয়ে উঠল সাগর

‘জী, সেটা এক মজার ঘটনা জানেন৷ আমি বিকালে হাতিরপুল গিয়েছিলাম আমার বাড়ির জন্যে কিছু স্যানিটারি জিনিস কিনব বলে৷ আমার বাসা আবার সোবহানবাগ বুঝলেন৷ আপনি তো ঢাকা অত ভাল চিনেন না যাক গিয়ে৷ তো হল কি৷ আমি যাওয়ার পথে দেখলাম সেন্ট্রাল রোডো অনেক জ্যাম৷ তো কি করার ড্রাইভার কে বল্লাম কি করা যায় বল তো, সে বল্ল স্যর ভূতের গলি দিয়ে মেরে দিব নাকি? রাস্তাটা খারাপ কিন্তু চলে যাওয়া যাবে ঠেলিয়ে ধাক্কিয়ে৷ আমি রাজি হলাম হঠাৎ মাথায় খেলে গেল ভূতের গলি৷ আপনি ভূতের গালে ব্যাপার টা বুঝলেন না তো ? ওটা ভূতের গলি , ভূতের গলি৷ আমাদের ঢাকায় একটা যায়গা আছে এই নামে৷ মেয়েটা ছোট মানুষ হয়তো বুঝেছে ভূতের গাল’

‘মাই গড’ বলে ফিস ফিস করল অকিল৷

‘আর সেই বাড়ি টা পাওয়া গেল ওটা?’

‘আরে হ্যাঁ সেই পুকুর, ভূতের গলির পুকুর কে না চিনে৷ অপয়া একটা পুকুর৷ প্রতি বছর দুই তিনটা বাচ্চা নিয়ে যায় ঐ পুকুর৷ ওখানে গিয়ে দেখি দিব্বি দাড়িয়ে আছে সেই এক তলা সাদা বিশাল রাজকীয় বাড়ি৷ সে কি এলাহি কান্ড৷ এর বিদেশি ব্যবসায়ীর বাড়ি ঐ বাড়ি জানেন? বাড়ি তো নয় যেন রাজ প্রাসাদ৷ রিশিতার কথা জিজ্ঞেস করতে বল্ল আপনাকে নিয়ে যেতে৷ না হলে এই নিয়ে কোনো কথা বলবে না৷ আমি বাড়ি সার্চ করতে চাইলাম বলে সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে আসতে৷ এখন বুঝতেই পারছেন৷ এসব কারণে ওয়ারেন্ট নেয়া ঝামেলা৷ তাও বিদেশি মানুষ কোন আমলা, কোন মন্ত্রীর সাথে খাতির আমি পরে একটা এমবারাসিং অবস্থায়….’

‘আমরা বুঝতে পেরেছি অসি সাহেব৷ আপনি অনেক উপকার করেছেন আরেকটু্ উপকার করেন৷ আমরা জাবেদ সাহেব আর উনার মেয়ে টাকে রেখে এসেছি হোটেলে৷ এখন আমরা এদিক দিয়ে যাই আপনি যদি ওদের একটু নিয়ে আসতেন কাউকে দিয়ে সেই বাড়িতে৷ আমার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে আমাদের লাগবে৷’

অসি সাহেব রাজি হলেন৷ কালাম নামে একজন কে ডেকে কি করতে হবে বলে দিলেন আমরা রওনা দিলাম সেই রাজকীয় বাড়িতে৷

এগার

এ বাড়ি তো শুধু বাড়ি না৷ যেন এক রাজ প্রাসাদ৷ বাড়ির গেটের  ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল বিশাল বড় দুটো সিংহের মূর্তি৷ দুই পাশে যেন তারা স্বাগত জানাচ্ছে৷

‘সিংহ দিয়ে স্বাগত? বাপ রে’ বলে উঠল সাগর

মেইন বাড়িটার আশে পাশে সুন্দর বাগান করা হয়েছে৷ হাসনা হেনার গন্ধে পুরো বাড়িটা মম করছে৷

বাড়ির ভেতরে ও রাজকীয়তার ছাপ পাওয়া গেল৷ দেয়াল মেঝে সব মার্বেল দিয়ে খোদাই করা৷ ড্রয়িং রুমে অনেক গুলো ছবি দেখা গেল৷ অকিল মনোযোগ দিয়ে সেই ছবি গুলো দেখছিল এমন সময় ঠুক ঠুক একটা শব্দ প্রতিধ্বনি হতে শোনা গেল৷ বেশ কিছুক্ষণ পর দেখা গেল নাইট গাউন পড়া একজন বৃদ্ধ এসে দাঁড়িয়েছেন তার হাতে একটা লাঠি৷ লোকটা একটা গলা কাশি দিয়ে

‘মি. অকিল’ কথা বলতে যেয়ে গলা টা ভেঙ্গে আসল বৃদ্ধের৷ দৌড়ে তার জন্যে পানি নিয়ে এল একজন লোক৷ আস্তে আস্তে ধরে বসিয়ে দিল একটা সোফায়৷

‘হাউ ডু ইউ ডু’ বলে সবার দিকে তাকাল যেন সবাইকেই কথা টা বল্ল অকিল৷

অকিল সারাসরি পয়েন্ট এ চলে এল

‘আমরা রিশিতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম৷ আপনি তো তার নানা হন তাই না?’

‘একটা বিশাল হাসি দিল বৃদ্ধ’ ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছে না সাগর৷ হচ্ছে টা কি৷ অকিল এসব কি বলছে রিশিতার নানা? রিশিতা বেচে আছে? মানি কি? হতাশ চোখে অকিলের দিতে তাকাল সাগর৷

‘ইউ আর রাইট মাই বয়, ইউ আর৷ তা রিশিতা এখানে আছে তোমাকে কে বল্ল৷ তোমরা তো তাকে কবর দিয়ে চলে এসেছিলে৷’

‘আপনি কি ডিনাই করছেন রিশিতা এখানে নেই?’

এদিকে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ পাওয়া গেল বাইরে থেকে৷ রীতি আর  জাবেদ সাহেব এসেছেন৷ সাথে  এসেছেন তার দাদা৷ রীতি রুমে ঢুকতেই বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন৷ আস্তে আস্তে রীতির দিকে এগিয়ে গেলেন৷ রীতির কাছে যেতেই বৃদ্ধের লাঠি টা হাত থেকে পরে গেল৷ হাত টা কাঁপছে ওনার৷ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল বৃদ্ধ৷ কাঁপা কাঁপা দুটো হাত দিয়ে মেয়েটার গাল দুটো ধরে কি যেন দেখলেন৷ কিছুক্ষণ পর যেন লোকটার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল৷ জড়িয়ে ধরলেন মেয়েটাকে৷ মেয়েটাকে ধরে এনে কোলের উপর নিয়ে বসলেন বৃদ্ধ৷ সোফার উপর বসে থাকা বৃদ্ধ আর রীতি যেন কত দিনের পরিচিত৷

‘কি হচ্ছে আমাকে কেউ কিছু বুঝিয়ে বলবেন?’ রীতিমত চিৎকার করে উঠল সাগর

বৃদ্ধ অকিলের দিকে তাকাল৷ যেন অকিল কে বলছে তুমিই বুঝিয়ে দাও৷  একটু হাসলেন বৃদ্ধ৷ অকিল বল্ল

‘ইনি রিশিতার নানা৷ বুঝতেই পারছ রীতি আমাদের মত সাধারণ কোনো মানুষ না৷ রীতির একটা অসুখ আছে৷ মেডিক্যাল ভাষায় অসুখটার নাম “ক্লেইন লেভিন সিন্ড্রোম” পৃথিবীতে হাতে গোনা মাত্র কয়েক জনের কয়েক জন বলতে ৫-৬ জনের ও কম মানুষের এই রোগ আছে৷ আর এর মাঝে ৩ জনই এই বাড়িতে এখন অবস্থান করছে৷ সুতরাং বুঝতেই পারছ কত রেয়ার রোগ এটা৷ রীতির সিমটমের সাথে অলমোস্ট সব গুলো সিমটোম ই এই রোগের সাথে মিলে যায়৷ টানা দীর্ঘ সময় ঘুমানো, অস্বাভাবিক ক্ষুধা, যৌন চাহিদা, অস্বাভাবিক ভাবে রেগে যাওয়া মন ভাল হয়ে যাওয়া, ডিপ্রেশন সব ই মিলে যায়৷ এই রোগের সিমটম সব গুলো৷ ’

‘তার মানে এখানে জীন ভূতের কিছু নেই? তাহলে এই যে রীতি, রীতি যে এসব বলছে, এই বাড়ির বর্ণনা, তোমার আমার ঢাকায় যাওয়ার কথা আমি যে ওর আসল বাবা, ওর মা যে কবরে নেই এগুলো? এগুলো ও কিভাবে জানে? এখন তুমি নিশ্চয় বলবে না এগুলো রোগের কারসাজি?’ চিৎকার করে কথা গুলো বল্ল সাগর

অকিল খেয়াল করল জাবেদ সাহেবের মুখের চেহারায় কোনো পরিবর্তন নাই৷

‘বাবা তুমি এগুলা কি বলতেস? রীতি তোমার মেয়ে মানে?’ বল্লেন জাবেদ সাহেবের বাবা৷

‘অকিল আবার শুরু করল৷ রীতির সাতে এই রোগের অন্য পেশেন্ট দের একটা গুরুত্বপূর্ণ তফাত আছে৷ আমি আগে বলে নেই রোগটা সম্পর্কে আমরা এখনো তেমন কিছুই জানি না৷ বুঝতেই তো পারছ মাত্র কিছু মানুষের আছে৷ এটা নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয় নি৷ অনেক কিছুই অজানা৷ তবে আমার যেটা মনে হয় রীতির ব্রেন অস্বাভাবাবিক বেশি গতিতে কাজ করে৷ এই জন্যে ও ক্লান্ত হয়ে যায়, আমাদের সাধারণ মানুষ থেকে অনেক বেশি ডেটা এরা প্রসেস করতে পারে৷ অনেক দ্রুত অনেক বড় ডিসিশন নিতে পারে৷ তাই ওর প্রেডিকশন ক্ষমতা বেশি৷৷ আর এর ফলে ক্লান্ত হলে আমাদের ব্রেন যা করে তা হল তার হোস্ট কে ঘুম পাড়িয়ে দেয়৷ এমন কি আমি খেয়াল করছি৷ রীতি যখন ঘুমায় তখন ও স্বপ্ন দেখে৷ আমার ধারনা ও তোর মা এর সাথে কমিউনিকেট করতে চায়৷ ট্যলিপ্যাথি বলি আমরা এটাকে বিজ্ঞান এর ভাষায়৷ তবে ওর ট্যালিকিনিসিস আছে কিনা আমি এখনো নিশ্চিত নই৷ সেদিন রাতে যখন আমি একটা আর্ত-চিৎকার শুনে বাইরে এলাম এটা আমার মনে হয় রীতি করে নি৷ আমার মনে হয় চিৎকার টা করছিল রীতির মা৷ আমার মনে হয় সে এখনো ঘুমে আছে৷ আপনারা যেটাকে মৃত্যু ভেবেছিলেন সেটা আসলে মৃত্যু নয়৷ অস্বাভাবিক ভাবে হার্ট রেট কমে  যায় এই রোগী গুলো ঘুমিয়ে পড়লে৷ অন্তত রীতি এবং তার মা এর ক্ষেত্রে তাই হয়৷ মনে রাখতে হবে এক একটা রোগ এক এক ভাবে এক এক জনকে প্রভাবিত করে৷ তবে প্রতিটি রোগ এর কিছু কমন ধর্ম থাকে৷ সেই কম ধর্ম গুলোই হচ্ছে দীর্ঘ সময় ঘুম, অস্বাভাবিক ক্ষুধা, যৌন চাহিদা, অস্বাভাবিক ভাবে রেগে যাওয়া মন ভাল হয়ে যাওয়া, ডিপ্রেশন৷  আর এই পরিবার এর ক্ষেত্রে এই সমস্যা গুলো বাদেও আলাদা কিছু লক্ষণ দেখা যায় আর সেগুলোই আমরা রীতির ব্যাপারে দেখছি৷

‘কিন্তু, কিন্তু, না না আমার এগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না৷’ চিৎকার করছে সাগর

‘মি. সাগর, পৃথিবী খুবই আজব আর অজানা একটা যায়গা৷ কতটুকু জানি আমরা পৃথিবী কে ? মধ্য যুগে আমরা যাদের ডাইনী বলে পুরিয়ে ফেলতাম এখনকার যুগে এসে দেখা যাচ্ছে তারা ছিল গবেষক, ডাক্তার৷ বিভিন্ন রোগ বালাই নিয়ে তারা কাজ করত৷ এত আগে প্রযুক্তি ছিল না, ল্যাব ছিল না৷ রোগ বালাই এক্সিডেন্টালই ছড়িয়ে পড়ত আর আমরা সাধারণ জনতা ছিলাম অজ্ঞ কুসংস্কার আচ্ছন্ন আমরা একটা কাজই পারতাম৷ যা কিছু পছন্দ হতনা ধ্বংস করে ফেলতাম৷ মানব জাতির ইতিহাসটাই এমন৷ আমরা যা সহ্য করতে পারি না তা ধ্বংস করে ফলি৷’

হা হা হাআআ’ হাসতে হাসতে কাশতে শুরু করলেন বৃদ্ধ৷

অকিল বৃদ্ধ কে জিজ্ঞেস করল

‘আপনার স্পাই টা কি সাদেক সাহেব অরফে চা ওয়ালা?’

কথা টা বলে বৃদ্ধের পাশে  রাজকীয় সোফার  পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়ানো লোকটার দিকে ইঙ্গিত করতেই লোক টা জ্বিহবা বের করে দাতে কামড়ে ধরল৷

‘বৃদ্ধ এবার হাসলেন৷ জী, আপনার আই কিউ অসম্ভব ভাল মি. অকিল৷ বলতেই হয়৷ ওকেই স্পাই হিসেবে ওই গ্রামে আমি গত ৮ বছর আগে পাঠাই৷ আমি জানতাম আমার নাতনীর সামনে অনেক কঠিন সময় আসবে৷ আপনি হয়তো জানেন এই রোগ গুলো ছোট বেলায় একবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে যেমন এখন রীতির বেলায় হচ্ছে৷ রোগটা চলে যায় কিছু বছর থেকে৷ আবার বয়স বাড়লে এক সময় এই রোগটা ফিরে আসে৷ আবার চলে যায় অবশ্য৷ একটা মানুষের জীবন নষ্ট করে দেয় জানেন এই রোগ গুলো? আমার বাবা মা কে ও পুরিয়ে মারে কলকাতার লোক জন৷ আমরা কোলকাতায় থাকতাম৷ ডাইনী উপাধি দিয়ে পুরিয়ে মারে ওরা৷ আমাকে বাচাতে যেয়ে আমার বাবা মা আর পালাতে পারে নি৷ আমার বাবা এর ও এই রোগ ছিল৷ আবার বাবা এর মা এর এই রোগ ছিল৷ তার, তার বাবা এর ও ছিল৷ তিনি ইউরোপ থেকে এই ভারতবর্ষে এসে পাড়ি জমিয়েছিলেন ব্যবসা করতে৷ পরে চলে যান আর কোনো খোজ পাওয়া যায়নি তার৷ যদিও তিনি কথা দিয়ে গিয়েছিলেন কিছু পয়সা পাতি কামিয়ে আবার ফিরে আসবেন তার ভালবাসার মানুষের কাছে৷ যাক গিয়ে সেই কথা৷ রিশিতা কে দেখতে চাইলে সাদেক আপনাদের ওর ঘড়ে নিয়ে যাবে৷ রিশিতাকে কবর দেয়ার পর সাদেক ই বুদ্ধি করে কব খুড়ে দেখে বেচে আছে কিনা৷ লোকটার বুদ্ধি আছে বলতে হবে৷ ওর পরিবার আমাদের পরিবারের অনেক পুরানো ভৃত্য৷ যুগ যুগ ধরে এদের পরিবার আমাদের সাহায্য করে যাচ্ছে৷ ও কোনো টাকা পয়সা ও নেয় না জানেন? শুধু জীবন টা বাচাতে হবে কয়টা টাকা অনেক কষ্টে গুজে দেই৷  এই যুগে এমন মানুষ পাওয়া খুব রেয়ার৷

‘আপনার ছেলে কেন এই অর্থ সম্পদ ছেড়ে ঐ অজ-পাড়া গায়ে চলে গিয়েছিল? আপনি অনেক কনজারভেটিভ বলে?’

‘তা বলতে পারেন, বোঝেন ই তো আমাদের এই রোগ যাদের হয় তাদের খুব সাবধানে চলতে হয়৷ আমি চাইতাম সে বাইরে টাইরে কম যাবে, খুব বুঝে শুনে বন্ধু বান্ধব করবে৷ কিন্তু একবার সে সেই কি এক গ্রাম অষ্টগ্রাম সেখানে যেয়ে এক গ্রামের যুবতির প্রেমে পড়ল৷ তার পর যা হয় আরকি আমার সাথে বনি বনা হল না৷ আমিও রাগ দেখালাম আরো ম্যচিউর হওয়া দরকার ছিল৷ ছেলেটার সাথে সম্পর্ক গেল৷ কিন্তু আমি সব সময় খোজ রেখেছি ছেলেটার৷ আমার আরেক নাতি যে আছে সে আমার খুব ভক্ত৷ ওর সাথে আমি আস্তে আস্তে ভাল সম্পর্ক করে তুলি৷’

‘একটা জিনিস রিশিতার প্রথম সিম্পটম টা দার্জিলিং এর এক্সিডেন্ট এর পড়ই দেখা দেয় না?’

‘হু, কোনো রকম ইনফেকশন এই রোগের রোগীদের জন্য খুব সমস্যা বুঝলেন৷ এই জন্যে আরো প্রটেকটিভ থাকতাম৷ আমাদের অটো ইমিউন সমস্যা আছে৷ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব নাজুক৷ মি. অকিল আপনি স্মার্ট মানুষ আপনি সব নিজেই বুঝবেন৷ অত তারাহুরা কি৷ যান সাগর কে নিয়ে রিশিতার কাছে যান৷ মেয়েটা এই ছোকরা কে খুব ভালবাসে৷ সরি মি. জাবেদ৷ কথা গুলো বলতে বলতে জাবেদ এর কাছে এসে ওর কাঁধে এসে একটা হাত রাখল বুড়ো৷ ’

জাবেদ শুধু মাথা নিচু করে থাকল৷ একটু পর বেরিয়ে গেল৷ রিশিতি ওর বউ হয়তো ছিল কিন্তু এর পর আর থাকা যায় না৷  যে মানুষটা ওকে কোন দিন ভালই বাসতে পারি নি অভিনয় করে গেছে তার জন্যে আর কি৷ এমনকি মেয়েটা ও ওর না৷ চলে গেলেন জাবেদ সাহেব বাবা টা কে ও নিয়ে গেলেন৷ যাওয়ার আগে রীতির দুই গাল দুটো চুমু দিয়ে বলে গেলেন ভাল থেক মা৷

বুড়ো অকিল আর সাগরের দিকে তাকালেন৷ এই প্রথম বুড়ো অকিলের দিকে চোখে চোখ রেখে তাকালেন৷ তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিলেন৷ এই অন্ধকারেও বুড়োর নীল চোখ গুলো পরিষ্কার বোঝা গেল, জ্বল জ্বল করছে চোখ দুটো৷ চোখ গুলো যেন অকিলের নাড়ী নক্ষত্র সব জেনে নিল৷ কেমন একটা অস্বাভাবিক লাগল অকিলের কাছে৷ পেটের ভেতর গুলিয়ে উঠল৷ বুড়ো সাদেকের দিকে তাকাল, সাদেক কে ইশারায় নিয়ে যেত বল্ল রিশিতার কাছে৷

রিশিতার কাছে ওদেরকে নিয়ে যাচ্ছেন সাদেক সাহেব৷

‘স্যার আমি তো চা ভাল বানাই না আপনি তাহলে আমাকে ঐ বাবে আপনার হোটেলে নিয়ে গেলেন কেন?’

‘সাদেক মিয়া আনার চা খেয়ে আমি ভাবছিলাম, এত বাজে চা আমি আমার বাপের জন্মেও খাই নাই৷ রহস্য টা কি? আপনি বললেন দিনে ২০০ টাকা রোজগার করেন তার মানে ২ টাকা করে কাপে প্রায় ৪০০ কাপ চা বেচেন৷ অসম্ভব৷ আপনার তো না খেয়ে মরার কথা এই বাজে চা বানিয়ে কেউ ২০০ টাকা রোজগার করতে পারে না৷ তবে অবশ্য এটা ঠিক আমি আপনার স্যার এর এই গ্র্যান্ড প্লান আর টিকটিকি গিরি এর ব্যাপারে কিছু জানতাম না৷ আমি মানুষটা কিউরিয়াস, যা কিছু তে অসংগতি দেখি তা ঘাটিয়ে দেখি৷ তাই আপনার রহস্য টা কি বুঝতে আমি আপনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ ’

‘সাদেক মিয়া হাসলেন, তা সার তখন আপনি আমাকে নিয়ে কি ভাবেছিলেন?’

‘আমি ভেবেছিলাম আপনি নতুন ব্যবসায় নেমেছেন৷ আমাকে গুল পট্টি মেরেছেন চা বিক্রির এমাউন্ট এর ব্যাপারে, এটা ভেবেছিলাম৷’

কথা বলতে বলতে রিশিতার রুমে পৌঁছে গেল অকিল৷ ভেতরে যেতে বলে বাইরে দাড়িয়ে থাকল সাদেক মিয়া৷

রীতি দৌরে মা এর রুমে ঢুকল৷ মা কে দেখে রীতির তেমন কোনো আবেগ দেখা গেল না৷ আস্তে আস্তে মা এর কাছে গিয়ে মা এর কাঁধের পাশে  বিছানায় যেয়ে বসল রীতি৷ মা এর মাথায় একটা হাত রেখে৷ যেন কি দেখল৷ হয়তো বল্ল মা আমি তোমার কাছে চলে এসেছি আর কোনো ভয় নেই৷ রিশিতা একটা বিছানায় শুয়ে আছে৷ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ও৷ কি সুন্দর দেখতে রিশিতা যেন সৃষ্টিকর্তা নিজের হাতে বানিয়েছেন, পরম যত্নে, অসীম মমতায়৷ রিশিতার উপর চাঁদের আলো অল্প এসে পড়ছে৷

‘A sleeping beauty.’ কথাটা ফিস ফিস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল অকিলের৷

পরিশিষ্ট

অকিল আর সাগর চলে যাবে গ্রামের বাড়ি৷ কমলাপুর ট্রেন স্টেশনে অনেক মানুষের ভীর৷ ট্রেন টা প্লাটফর্মে এসে লাগতে টাইম লাগছে  কোনো কারনে৷

অকিল বল্ল

‘তোরা ভাল জুটি হোতি রে, তোর উচিত ছিল ফাইট করা’

‘কথাটা শুনে হু হু করে কেঁদে উঠল সাগর৷’

সাগরের কান্না যেন শুনল না অকিল, বলে গেল

‘দুজন মিলে গভীর রাতে হারিকেন টা জ্বলে উপন্যাস পড়তি৷ আর তোদের সন্তান তোদের পাশে ঘুমাত৷ তোরা মাঝে মধ্যে তোদের বাচ্চার মুখ টা দেখতি, আবার বই পড়ায় মনোযোগ দিতি৷ রিশিতার দ্রুত পড়তো, তোর জন্য ও অপেক্ষা করত কখন তোর ও পাতা টা শেষ হবে৷ ও অভিমানের সুরে বলত আপনি একটু দ্রুত পড়তে পারেন না৷ ধুর কি একটা ক্লাইম্যাক্স এখন আপনার জন্যে আমি অপেক্ষা করি৷ কেন বাবা বলি আপনি নিজে নিজে পড়তে পারেন না? রিশিতা মুখ বানাত৷ রিশিতারকে রাগলে বেশ সুন্দর লাগে তুই ইচ্ছে করে আরেকটু সময় নিয়ে পড়তি৷’

কথা গুলো শুনে আরো হু হু করে বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠল অকিল৷

‘দুজনই বই পড়তে ভালবাসিস, বই দিয়েই তোদের পরিচয় টা হয়েছিল৷ কত মধুর একটা ব্যাপার, সাগর শুনছিশ’

সাগর অকিলের দিকে জলে ভেজা চোখে তাকাল৷  অকিল বল্ল

‘ফাইট টা কিন্তু যেকোনো সময় করা যায়৷ দেরি হয়ে গেছে বলতে কিছু নাই জানিস তো?’

সমাপ্ত

 

To know more about Kleine-Levin Syndrome (Also known as Sleeping Beauty) click here or click here or here.

What are the symptoms of Kleine-Levin syndrome?

Symptoms usually begin in early adolescence and recur usually more than once per year. The average duration of KLS is 14 years. Symptoms include:

    1. Extreme sleepiness and inability to stay awake.

    1. Increased appetite (hyperphagia).

    1. Increased sex drive (hypersexuality).

    1. Hallucinations.

    1. Irritability or behavioural changes.

    1. Anxiousness or depression.

    1. Confusion or amnesia.

An episode occurs when you experience these symptoms for at least two days. KLS episodes can last for a few days, average around 10 days, or could last for a couple of weeks. One study suggests that people diagnosed with KLS have an average of 20 episodes during their lifetime.

Most people have trouble remembering what happens during an episode. They can wake up during an episode to eat or use the restroom but have limited physical function due to excessive sleepiness.

After you experience an episode, you’ll go back to your normal patterns of behaviour and not have any symptoms of the condition except for possibly mild cases of memory loss.

What triggers a Kleine-Levin syndrome episode?
Certain events trigger symptoms of KLS, including:

    1. Flu-like illness or infection.

    1. Drug and alcohol use.

    1. Head trauma.

    1. Physical exertion.

    1. Stress.

What causes Kleine-Levin syndrome?
The cause of Kleine-Levin syndrome is unknown. Some studies suggest that an illness or injury causes damage to the part of your brain that regulates sleep (hypothalamus).

Most cases of KLS occur after having an illness similar to the flu or an infection. Research speculates that KLS could cause an autoimmune response where your body confuses healthy tissue with an invading organism, which causes symptoms. Other research suggests that KLS could be genetic, related to mutations in genes LMOD3 and TRANK1.

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!